Site Logo | মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ব্রেকিং নিউজ

সাফল্যের পরও অর্থসংকটে নারী ফুটবল

সাফল্যের পরও অর্থসংকটে নারী ফুটবল

ছবি: সংগৃহীত

Advertisement

সব স্তর মিলিয়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল টুর্নামেন্ট জিতেছে ১১টি, এত ট্রফি দেশের আর কোনো দল জেতেনি। অতি সম্প্রতি এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে নাম লিখিয়েছে সিনিয়র ও জুনিয়র নারী দল, বাংলাদেশের ফুটবলে এটাও প্রথম। এত এত সাফল্যে প্রশংসায় ভাসছেন বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। তবু অর্থকষ্ট তাঁদের পিছু ছাড়েনি। বেতন কম, সেটাও সময়মতো পান না খেলোয়াড়রা। খাবার কিংবা অতি প্রয়োজনীয় ক্রীড়া সরঞ্জামের মান নিয়েও আপস করতে হয় মেয়েদের।

সম্প্রতি কিছু পরিবর্তন অবশ্য হয়েছে। যেমন—লাওসে এশিয়ান কাপ চূড়ান্ত পর্বের প্রস্তুতিকালে নামি হোটেলে রাখা হয়েছিল খেলোয়াড়দের। বিনিময়ে র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা দলকে টপকে চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছেন ঋতুপর্ণারা। তবে এটা সাময়িক বন্দোবস্ত, ঢাকায় নারী ফুটবলারদের ঠিকানা বাফুফের একাডেমি ভবন। কোচ পিটার বাটলারের পীড়াপীড়িতে অবশ্য খাবারের মান কিছুটা উন্নত হয়েছে। বুটের পৃষ্ঠপোষক পাওয়া গেছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় দলের এক ফুটবলারের মন্তব্য, ‘ভালো বুট ভালো খেলার অন্যতম প্রধান একটি জিনিস। টাকার অভাবে গুলিস্তান মার্কেট থেকে নিম্নমানের বুট কিনতাম। এখন স্পন্সর এসেছে। তবে এর চেয়েও ভালো বুট বাজারে আছে।’ সময়মতো বেতন না পাওয়া কিংবা প্রতিশ্রুত পুরস্কারের অর্থের অপেক্ষায় থাকা এই খেলোয়াড়ের আক্ষেপ, ‘নানা সময়ে আমাদের টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবতে হয়।

Advertisement

বেশির ভাগ মেয়ের টাকায়ই তাদের পরিবার চলে। সেই টাকাটা যদি নিয়মিত না পাই, তাহলে কিভাবে হবে? মানসিকভাবে ভালো না থাকলে আমরা ভালো খেলব কী করে?’ মোট ৫৫ নারী ফুটবলার আছেন বাফুফের বেতনকাঠামোয়, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে যাঁদের বেতন পাঁচ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

অভাবনীয় সাফল্য এনে দেওয়া নারী ফুটবলে সেই অর্থে শক্তিশালী কোনো কাঠামো নেই। নামকাওয়াস্তে একটা লিগ অবশ্য হয়, যে আসরে খেলোয়াড়দের প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির গল্পই বেশি শোনা যায়। দিনশেষে খেলোয়াড়দের একমাত্র আশ্রয়স্থল বাফুফে ভবন। আবাসন, খাবার, ক্রীড়া সরঞ্জামের সঙ্গে প্রস্তুতির জন্য নির্দিষ্ট মাঠও নেই নারী দলের। আজ কিংস অ্যারেনা তো কাল ফর্টিসের একাডেমি ঘুরে পরশু আবাহনীর মাঠে চলে প্রস্তুতি, যা মোটেও আদর্শ নয়।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সদস্য ও নারী ফুটবল কমিটির প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণ অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন যাবতীয় ঘাটতির কথা, ‘আমরা অনেক কিছুই পরিকল্পনা করি। কিন্তু নানা কারণে সেসব বাস্তবায়ন করতে পারি না।’ এক মাসের ব্যবধানে বাংলাদেশের দুটি দল প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের মঞ্চে জায়গা করে নেওয়ায় নানা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বাফুফেতে। কিন্তু সব কর্মপরিকল্পনা আটকে আছে অর্থাভাবে। সেই অভাব মেটাতে পৃষ্ঠপোষক খুঁজছেন বলে জানিয়েছেন মাহফুজা, ‘যেভাবেই হোক পৃষ্ঠপোষক খুঁজে আনব।’ 

নারী দলের পৃষ্ঠপোষক অবশ্য আছে। ২০১৮ সাল থেকে নারী দলের স্পন্সর ঢাকা ব্যাংক। মেয়েদের টানা সাফল্য তাঁদের আরো অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার, ‘টানা দুটি সাফ জিতেছে মেয়েরা। এখন এশিয়ান কাপেও খেলবে। আমরা গর্বিত তাদের স্পন্সর করতে পেরে। আমাদের চেষ্টা থাকবে সব সময় এই মেয়েদের পাশে থাকার।’ তবে একটি মাত্র পৃষ্ঠপোষকের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ যে নারী ফুটবলের অর্থসংকটের সমাধান নয়, সেটি পরিষ্কার।

Advertisement

এদিকে, এশিয়ান কাপে বাংলাদেশকে খেলতে হবে এ অঞ্চলের শীর্ষ দলগুলোর বিপক্ষে। সিনিয়র দল খেলবে উত্তর কোরিয়া, চীন ও উজবেকিস্তানের বিপক্ষে। এই দলগুলো আধুনিক ফুটবল ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের চেয়ে যোজন দূরত্বে এগিয়ে। আধুনিক অনুশীলন ব্যবস্থা, আবাসন, পুষ্টি—সব সুবিধাই উন্নতমানের। সে তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েদের সম্বল অদম্য মনের জোর। অবশ্য ঋতুপর্ণাদের প্রথমবার ফুটবলে লাথি দেওয়াও ছিল প্রলয়কাণ্ড!

এক দশক আগেও এ দেশে ফুটবল ছিল ‘ছেলেদের খেলা’। সমাজ, পাড়া-প্রতিবেশী তো বটেই, ঘরেও নারীদের ফুটবল নিয়ে ঘোর আপত্তি ছিল। সাগরিকার বাবা লিটন আলী তো হুমকি দিয়েছিলেন যে ফুটবল খেললে মেয়ের সঙ্গে তাঁর মাকেও ঘরছাড়া করবেন! দেশব্যাপী স্কুল ফুটবল আয়োজনের সময় অঞ্চলভেদে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সহায়তাও নিতে হয়েছিল বাফুফেকে। তবে দিন বদলেছে। 

যুবদলের তারকা সাগরিকার পিতা লিটন আলী এখন মেয়েকে নিয়ে গর্ব করেন, ‘আমি চাইতাম না যে আমার মেয়ে ফুটবল খেলুক। এলাকার মানুষজন খুব বাজে কথা বলত। কিন্তু আমার মেয়ে হাল ছাড়েনি। খেলতে খেলতে এখন কত কত দেশে যাচ্ছে! মানুষ ওরে এখন চেনে। এলাকায় তো এখন ওর খুব নামডাক। আমার খুব ভালো লাগে। ওর দেখাদেখি অনেক মেয়ে এখন ফুটবল খেলা শুরু করে দিয়েছে।’ জাতীয় দলের অধিনায়ক আফঈদা খন্দকারের বাবা খন্দকার আরিফ হাসান নিজেই মেয়েকে মাঠে নিয়ে যেতেন। তবে বুঝতেন, অগণিত বাঁকা চোখ তাঁদের অনুসরণ করত, ‘এলাকার মানুষজন আড়চোখে দেখত। মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে? খেলে কী করবে? জাহান্নামে যাবে! এসবও শুনতে হয়েছে। মেয়েরা ফুটবল খেলে বাড়ি যাওয়ার পথেও বাধার সম্মুখীন হতো। এমনকি পুলিশ প্রশাসনের সাহায্যও নিতে হতো।’

সেসব সংকট আর নেই। সাফল্যের আনন্দধারায় সেই সংকট ধুয়ে দিয়েছেন নারী ফুটবলাররা। প্রতিবছর স্কুল ফুটবল হয় বিনা বিপত্তিতে। এমনকি গ্রামাঞ্চলেও এখন মেয়েদের টুর্নামেন্ট হয়। কিছুদিন আগে দিনাজপুরে লাখ টাকার টুর্নামেন্টে খেলেছেন সাগরিকা, কোহাতি কিসকু, স্বপ্না রানীরা। ঠাকুরগাঁওয়ের রাঙ্গাটুঙ্গী ফুটবল একাডেমির পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই অঞ্চলে এখন অনেক ম্যাচ হয়, টুর্নামেন্ট হয়। যদিও মেয়েরা নানা সমস্যা ও বাধার সম্মুখীন হয়; কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কমে আসছে। জয়পুরহাটে মেয়েদের টুর্নামেন্টে ভাঙচুর করা হলো। সরকারকে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। তবে এটা সত্যি যে জাতীয় দল ভালো করায় অনেক অভিভাবক এখন তাঁদের মেয়েদের ফুটবল শেখাতে আগ্রহী হচ্ছেন। সারা দেশে এটা ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।’

সাফল্যের কারণে নারী ফুটবল নিয়েও বাফুফেকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এশিয়ান কাপের আগে নারী দলের প্রস্তুতি ক্যাম্প জাপানে করার পরিকল্পনা করেছে বাফুফে। জাপান ফুটবল ফেডারেশনকে সে বিষয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডের মতো দেশকে প্রস্তাব দিয়েছে বাফুফে। মাহফুজা আক্তার আশাবাদী, সেরা প্রস্তুতি নিয়েই এশিয়ান কাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় যাবে বাংলাদেশ দল, ‘প্রস্তুতিতে আমরা কোনো ঘাটতি রাখব না। মেয়েরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে খেলতে যাবে। এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই।’

মাঠের খেলায় ঋতুপর্ণা, আফঈদারা দারুণ সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু র‌্যাংকিংয়ে ১০০-র বাইরে থাকায় অনেক বড় দলই এত দিন প্রীতি ম্যাচ খেলতে চাইত না। এখন এশিয়ার সেরা ১২ দলের একটি হয়ে যাওয়ায় শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খেলার দরজা খুলে গেছে। বেশি বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে নারী ফুটবলের উন্নতিও হবে। কিন্তু ম্যাচ আয়োজনের পাশাপাশি ঘরোয়া আসর এবং খেলোয়াড় তৈরির আধুনিক ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। আর এ উপাদানগুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অর্থের কোনো বিকল্প নেই, যা বাফুফের কোষাগারে আপাতত নেই! 
 
নারী ফুটবল দলের যত অর্জন...

সিনিয়র দল
সাফ - ২ বার (২০২২ ও ২০২৪)
একুশে পদক (২০২৫)
২০২৬ এশিয়ান কাপ মূল পর্ব (২০২৫)

অনূর্ধ্ব-২০
সাফ - ২ বার (২০২৩ ও ২০২৫)

Advertisement

অনূর্ধ্ব-১৯
সাফ - ২ বার (২০২১ ও ২০২৪)

অনূর্ধ্ব-১৮
সাফ - ১ বার (২০১৮)

অনূর্ধ্ব-১৭
এশিয়ান কাপ মূল পর্ব - ১ বার (২০০৫)

অনূর্ধ্ব-১৬
সাফ - ১ বার (২০১৫)
এশিয়ান কাপ মূল আসর - ২ বার (২০১৭ ও ২০১৯)

অনূর্ধ্ব-১৫
সাফ - ১ বার (২০১৮)

Advertisement
Advertisement
Advertisement
Loading...
×