৩৩ বছর পর গণতন্ত্রের রঙে রাঙা জাবি ক্যাম্পাস

ছবি: সংগৃহীত
সবুজের ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) এখন এক ভিন্ন রঙের অপেক্ষায়-গণতন্ত্রের রং। দীর্ঘ ৩৩ বছরের শূন্যতা কাটিয়ে আগামী ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহু প্রতীক্ষিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ঘুম ভাঙা জাবি ক্যাম্পাস যেন ফিরে পেয়েছে তার হারানো প্রাণ, প্রতিটি আনাচে-কানাচে বইছে ভোটের আমেজ।
জাকসু, যা জাবির শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি আদায়ের মূল মঞ্চ, সর্বশেষ নির্বাচন দেখেছিল ১৯৯২ সালে। দীর্ঘ এই বিরতি ক্যাম্পাসে তৈরি করেছিল এক ধরনের নেতৃত্বের শূন্যতা। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া, সাংস্কৃতিক বিকাশ ও নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল সীমিত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ কেবল নেতৃত্ব তৈরি করে না, এটি গণতন্ত্রের প্রথম পাঠশালা। এই নির্বাচন সেই সুযোগ ফিরিয়ে আনছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটের মাধ্যমে নিজেদের অভিভাবক নির্বাচন করবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হবে।
ভোটের হাওয়ায় সরগরম জাবি
তফসিল ঘোষণার পর থেকে জাবি এখন সরগরম। আবাসিক হল, বটতলা, মুরাদ চত্বর, ক্যাফেটেরিয়া, চৌরঙ্গী- সব আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু এখন নির্বাচন। শিক্ষার্থীরা দল-মত নির্বিশেষে প্রার্থীদের নিয়ে আলোচনা করছেন, হল সংসদের পাশাপাশি জাকসুর ২৫টি পদের জন্য চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন তাদের প্যানেল নিয়ে মাঠে নেমেছে। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র দল, ছাত্র শিবির, ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস)-সহ অন্যান্য জোট ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের দুয়ারে দুয়ারে যাচ্ছেন। নানা প্রতিশ্রুতি আর ক্যাম্পাসের সমস্যা সমাধানের বার্তা নিয়ে চলছে প্রচার-প্রচারণা।
দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো যেমন-আবাসন সংকট, গণরুম সমস্যা, পরিবহন, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক চর্চার বিকাশ-এসবই এখন ভোটারদের আলোচনার মূল বিষয়। শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্যাম্পাসের এই মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।
জাবির বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ জাকসু নির্বাচন দেখছে তাদের জীবনের প্রথম গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ হিসেবে। প্রায় ১২ হাজার ভোটার তাদের মতামত জানানোর অপেক্ষায় আছেন, যা এই নির্বাচনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়েছে। তরুণ ভোটারদের মাঝে এই গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা এক নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে।
দীর্ঘ বিরতির পর ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের বিপুল আগ্রহ দেখা গেছে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে। জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য মোট ৭৪০ জন শিক্ষার্থী মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে জাকসুর ২৫টি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৭৩ জন, যা নতুন নেতৃত্বের জন্য শিক্ষার্থীদের গভীর আগ্রহেরই প্রতিফলন। বাকি ৪৬৭ জন হল সংসদের জন্য মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। মোট ১১ হাজার ৯১৯ জন ভোটার- যার মধ্যে ছাত্র ভোটার ৬ হাজার ১০২ জন এবং ছাত্রী ভোটার ৫ হাজার ৮১৭ জন- আগামী ১১ সেপ্টেম্বর তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘সংগঠন দেখে ভোট দেওয়াটা বিবেচনায় নেই। আমরা দেখব প্রার্থী মানুষ হিসেবে কেমন, কে কাজ করেছে, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। যোগ্য প্রার্থীদের ভোট দেবো। যে আমাদের জন্য কাজ করবে, আমাদের অধিকার আদায়ে আগামীতে কাজ করতে আগ্রহী তাকেই সব শিক্ষার্থীরা নির্বাচিত করবে বলে আমি আশাবাদী।’
জার্নালিজম ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রুবেল হোসেন বলেন, ‘জাকসুতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় থাকবে প্রার্থীর কাজ করার স্পৃহা, তার ইতোপূর্বের অভিজ্ঞতা এবং দলমত নির্বিশেষে সব সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য তার ভাবনা, কী কী কাজ তিনি করতে চান। শিক্ষার্থীদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যে ঘটাতে পারবে সেই নির্বাচিত হবে বলে আমরা মনে করছি।’
প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ
দীর্ঘ বিরতির পর নির্বাচন আয়োজন যেমন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা, নির্বাচনের পর বিজয়ী ও পরাজিত পক্ষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ শুরু করা- এগুলোই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।
তবে এই নির্বাচন জাবি ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির নবযাত্রা হিসেবে চিহ্নিত হতে চলেছে। ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেমন তাদের পছন্দের নেতৃত্ব বেছে নেবে, তেমনি ছাত্র সংসদ হয়ে উঠবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্র চর্চার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ৩৩ বছর পর আসা এই সুযোগ কেবল একটি নির্বাচন নয়, এটি জাবি ক্যাম্পাসের হারানো গণতন্ত্রকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই নির্বাচনই হয়তো ভবিষ্যতের সৎ, যোগ্য ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বিকাশের পথ প্রশস্ত করবে।
সার্বিক বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম গণমাধ্যমকে জানান, ‘নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের ক্যাম্পাসে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোতে আমরা সতর্ক রয়েছি। নির্বাচনে প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেই পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এজন্য সব অংশীজনের সহযোগিতা কামনা করছি।’
রাশিদুল আলম আরও জানান, ‘আমরা প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করছি। নির্বাচনের সামগ্রিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য সবার মতামত নিচ্ছি। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজন তা করতে প্রস্তুত রয়েছি।’