
৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বড় মোড় নেয়। দেশের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারায় আওয়ামী লীগ সরকার। একই দিনই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপত্তার খোঁজে ভারতে আশ্রয় নেন। দলের একের পর এক শীর্ষ নেতা দেশ ছাড়েন, কেউ কেউ আবার গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। এসব ঘটনায় দলটির সাংগঠনিক ভিত্তি একরকম ভেঙে পড়ে, আর মাঠের কর্মীরা পড়ে চরম বিভ্রান্তির মুখে।
এই সংকটের মধ্যেই আসে আরেকটা চমক। শেখ হাসিনার ছেলে ও রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিত সজীব ওয়াজেদ জয় গ্রহণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব। বিষয়টি দ্রুতই দলীয় কর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, আর তাতে হতাশা বেড়ে যায় বহুগুণ। অনেকেই মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের জন্য ‘শেষ ধাক্কা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সে সময় ভাগ্যক্রমে দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তখনও দল বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন—আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আদর্শের উত্তরাধিকার আসবে, না রক্তের?
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মার্চ দেশে ফিরে আসেন এবং দলের হাল ধরেন। ধীরে ধীরে দলকে সংগঠিত করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান শেখ হাসিনা এবং টানা ১৬ বছর দেশ শাসন করেন।
জয় ছিলেন ভবিষ্যতের আশার আলো

দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই বিশ্বাস করতেন—শেখ হাসিনার অবর্তমানে নেতৃত্বে আসবেন সজীব ওয়াজেদ জয়। যদিও তিনি দেশের বাইরে থাকতেন, তবুও দলের অনেক সিদ্ধান্তে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রযুক্তি খাতে তার পরিকল্পনা এবং পরামর্শেই গড়ে ওঠে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রকল্প। তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবে তার ভূমিকা ছিল বলার মতো।
দলের ভেতরেও একটি বড় অংশ গড়ে ওঠে যারা নিজেদের পরিচয় দিতেন ‘জয়-অনুগামী’ হিসেবে। অনেকে বিশ্বাস করতেন, জয়-ই ভবিষ্যতের কান্ডারি হবেন। এমনকি, ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পরও তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলছিলেন। ফলে নেতাকর্মীরা ধরে নিয়েছিলেন—আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তার হাতেই থাকবে।
নাগরিকত্ব নিয়ে নেতাকর্মীদের মন ভেঙেছে
ঠিক এমন একটা সময়, যখন পুরো দল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে, নেতারা আত্মগোপনে বা কারাগারে, মাঠপর্যায়ের কর্মীরা দমন-পীড়নের মুখে—তখন সজীব ওয়াজেদ জয়ের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করাটা নেতাকর্মীদের জন্য ছিল এক কঠিন বাস্তবতা।
জানা গেছে, সম্প্রতি ওয়াশিংটন ডিসির ইউএস সিটিজেনশিপ সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব শপথ নেন। তিনি ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া তিন বাংলাদেশির একজন। শপথ শেষে তিনি মার্কিন পাসপোর্টের জন্য আবেদনও করেন।
এর আগে ২০১৮ সালে নিজের ফেসবুক পেজে জয় জানিয়েছিলেন, তার কোনো বিদেশি পাসপোর্ট নেই এবং তিনি এখনো বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। এমনকি বলেছিলেন, “বাংলাদেশি পরিচয়ই আমার গর্ব।” তার সেই বক্তব্য আজ অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগায়।
নেতৃত্বহীনতায় দিক হারানো আওয়ামী লীগ
নেতাকর্মীদের কথায় বোঝা যায়, জয়কে ঘিরে যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, তা এখন ভেঙে গেছে। অনেকেই বলছেন—এমন সংকটে জয় যদি সামনে এসে দাঁড়াতেন, তাহলে নেতাকর্মীরা সাহস পেতেন। কিন্তু তিনি নিজেই পেছনে সরে গেলেন। দলের একজন সিনিয়র নেতা হতাশ গলায় বলেন, “জাহাজ যখন ডুবছে, তখন কাপ্তানও সরে গেলেন। এখন তো আর কিছুই বাকি নেই।”
আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। কিন্তু এখন, দলটির অস্তিত্ব নিয়েই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন—এই দল কি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?