ডেস্ক রিপোর্ট।।
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য
নিষেধাজ্ঞার হুমকি উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে খনিজ তেল কেনা অব্যাহত রাখার
পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য আরও বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
তিনদিনের মস্কো সফরের প্রথম দিনেই এস
জয়শঙ্কর বলেছেন, রাশিয়ার সংস্থাগুলি ভারতের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যাতে
বাণিজ্য করতে পারে, তার পরিবেশ রয়েছে ভারতে।
রাশিয়ার কাছ থেকে খনিজ তেল কেনা বন্ধ না
করার কারণে ভারতের ওপরে যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যেই
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মস্কোর সঙ্গে দিল্লির বাণিজ্য বৃদ্ধির আহ্বান
জানালেন।
আবার দুদিন আগেই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
সঙ্গেও একাধিক ‘ইতিবাচক’ বৈঠক করেছেন ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব। এবং দিল্লির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে যে, সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা
এসসিও-র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে চীন সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদী।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে
দেওয়ার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার প্রতি ভারতের এই অবস্থান এবং চীনের সঙ্গে সখ্যতা
বৃদ্ধিকে আমেরিকার ‘হুমকি উপেক্ষা করার মনোভাব’ হিসাবেই দেখছে ভারতীয়
গণমাধ্যমের একাংশ।
‘চার বছরে ভারত-রাশিয়ার বাণিজ্য পাঁচগুণ বৃদ্ধি’
‘আইআরআইজিসি-টেক’ নামে ভারত ও রাশিয়ার দুই
দেশের সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক একটি সংগঠনের বৈঠকে
এস জয়শঙ্করের ভাষণ প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ওই বৈঠকে এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘গত চার বছরে
আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পাঁচগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। যে বাণিজ্যের
পরিমাণ ২০২১ সালে ছিল ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার, তা ২০২৪-২৫ সালে
বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।
‘তবে এই বৃদ্ধির সঙ্গেই বড়সড় বাণিজ্য ঘাটতিও
রয়েছে- যা ছিল ৬৬০ কোটি মার্কিন ডলার, তা বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৮৯০ কোটি
ডলার- প্রায় নয় গুণ। এই পরিস্থিতির দিকে আমাদের দ্রুত নজর দেওয়া
দরকার,’ বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী।
এস জয়শঙ্কর উল্লেখ করেন, ‘একটি জটিল ভূরাজনৈতিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই পরিস্থিতিতেও দুই
দেশের শীর্ষ নেতারা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছেন এবং ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে
যে বিশেষ ও সুবিধাপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারীত্ব রয়েছে, তা এগিয়ে নিয়ে যেতে
দুই শীর্ষ নেতাই বদ্ধপরিকর।
অন্যদিকে, রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী ডেনিস
মন্তুরোভকে উদ্ধৃত করে দিল্লিতে দেশটির দূতাবাসের পক্ষ থেকে এক্স
হ্যান্ডেলে লেখা হয়েছে, ‘গত পাঁচ বছরে ভারত-রাশিয়ার বাণিজ্য ৭০০ শতাংশেরও
বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।’
এস মন্তুরোভ এও বলেছেন, ‘রাশিয়ার বাণিজ্য-অংশীদারদের মধ্যে ভারত এখন শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে উঠে এসেছে।’
ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের সুবিধা
এস জয়শঙ্কর ইন্ডিয়া-রাশিয়া বিজনেস ফোরামের
সম্মেলনেও যোগ দেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সেখানে তুলে ধরেন, রাশিয়ার
সংস্থাগুলির ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুকূল কী কী পরিবেশ তার দেশে রয়েছে। ‘মেক
ইন ইন্ডিয়া’র মতো কর্মসূচী বিদেশীদের ব্যবসা করার জন্য নতুন পরিবেশ তৈরি
করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
তার কথায়, ‘চার লাখ কোটি মার্কিন ডলারের
বেশি জিডিপি নিয়ে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ। অদূর ভবিষ্যতে
নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন স্বাভাবিকভাবেই আসবে। সার,
রাসায়নিক, যন্ত্রের মতো অত্যাবশ্যক পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা যেতে পারে।
নিজেদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই যেসব সংস্থা
প্রতিষ্ঠিত, তাদের জন্য দ্রুত গড়ে ওঠা পরিকাঠামো তৈরি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেছেন যে ভারতের আধুনিকীকরণ ও
নগরায়নের ফলে জীবনযাত্রা ও ভোগের ধরণ বদলিয়েছে, তাই চাহিদা এমনিতেই রয়েছে।
একারণেই ‘রাশিয়ার সংস্থাগুলির কাছে আহ্বান যে তারা যেন ভারতীয় সংস্থাগুলির
সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হয়।’
ট্রাম্পের ‘হুমকি’ ও রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির আহ্বান
ভারত এমন একটা সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য
বৃদ্ধির আহ্বান জানালো বা রাশিয়ার সংস্থাগুলিকে ভারতের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ
বৃদ্ধির কথা বলল, যখন ওই রাশিয়া থেকে খনিজ তেল কেনার কারণেই ট্রাম্প
প্রশাসনের রোশানলে পড়তে হয়েছে দিল্লিকে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকের আগে মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি
স্কট বেসেন্ট একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘রাশিয়ার তেল কেনার জন্য আমরা
ভারতের ওপরে শুল্ক চাপিয়েছি। যদি পুতিনের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হয়,
তাহলে যে শুল্ক বাড়ানো হবে তা স্পষ্ট। এই নিষেধাজ্ঞায় আমাদের সঙ্গে
ইউরোপীয়দেরও যোগ দেওয়া উচিত।’
ওই বক্তব্য যে ভারতের প্রতি স্পষ্টই
‘হুমকি’, তেমনটাই মনে করছেন ভারতের বিশ্লেষকদের অনেকে। ‘অনন্তা
সেন্টার’ বিদেশ নীতি সংক্রান্ত থিংক ট্যাংক। সংস্থাটির প্রধান
কার্যনির্বাহী ইন্দ্রাণী বাগচি স্কট বেসেন্টের সাক্ষাতকারের ভিডিওর একটি
অংশ তার এক্স হ্যান্ডেলে রিপোস্ট করেছেন।
সেখানে ইন্দ্রাণী বাগচি লিখেছেন, ‘এটা
বিপজ্জনক। পশ্চিমারা মনে করে রাশিয়ার কাছে ভারতের একটা বিশেষ স্থান আছে,
তাই পুতিনকে রাজি করাতে ভারতকে সাজা দাও। পুতিন নিজের স্বার্থ থেকে সরে
আসেন না আর ভারতের ক্ষতি হল কী না, তা নিয়ে তার কিছু যায় আসে না। এই
পরিস্থিতিতে ভারত যেন ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’ হয়ে উঠবে, আর এমন কিছু সিদ্ধান্তের
দ্বারা তারা প্রভাবিত হবে, যেগুলি নেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনও হাত থাকবে
না।’
ইন্দ্রাণী বাগচির ওই পোস্ট আবার রিপোস্ট
করেছেন, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তনভি মাদান। তিনি লিখেছেন,
‘যদি ট্রাম্প ভারতকে সমস্যায় ফেলতে চান তাহলে পুতিনেরই সুবিধা হবে। ভারত আর
আমেরিকার সম্পর্ক খারাপ হবে আর রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক আরও মজবুত করার
দাবি উঠবে ভারতে অভ্যন্তরে। এই অবস্থায় চিনের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য
প্রস্তুতি নিতে থাকবে ভারত।’
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের
রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্রের সহযোগী অধ্যাপক ড. রজন কুমার মনে
করেন, বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ভারত এখন একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
তার কথায়, ‘ভারতের ওপরে যে কোনও একটি
গোষ্ঠি বেছে নেওয়ার জন্য চাপ বাড়ছে, যেটা কোনও অর্থেই ভারতের স্বার্থের
অনুকূলে নয়। আমেরিকার কারণে ভারত রাশিয়াকে ছাড়তে পারবে, আবার শুধুই রাশিয়ার
দিকে ঝুঁকেও থাকতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী মোদীর এসসিও সম্মেলনে যোগ
দিতে চীন সফরের ঘোষণার মাধ্যমেই বোঝা যায় আমেরিকার নেতৃত্ব নেই, এমন
গোষ্ঠীতে বেশি সক্রিয় হতে চাইছে ভারত।’
এরকম একটা ভূ-রাজনৈতিক আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে
যে যেতে হচ্ছে ভারতকে, সে কথা মস্কো সফরে স্বীকারও করে নিয়েছেন দেশটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।