
সাতক্ষীরায় জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে গবেষণা
সাতক্ষীরার উপকূলীয় জনপদে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এমন তথ্য উঠে এসেছে এক অনুসন্ধানে।
জেলার শ্যামনগর উপজেলার ১৪টি গ্রামের ৩১ জন কৃষকের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই গবেষণাটি পরিচালনা করে বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)।
বুধবার (০৬ আগস্ট ২০২৫) বেলা ১১টায় শ্যামনগর প্রেসক্লাব হলরুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষকরা জানান, প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজনে কীটনাশকের ব্যবহার এখন বাস্তবতা হলেও এর অন্ধ ও অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই অঞ্চলের কৃষকদের উপর পরিচালিত অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষায় আমরা পেয়েছি কীটনাশক ব্যবহারের কারণ, উৎস, পদ্ধতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, পরিবেশগত ক্ষতি এবং আর্থিক বিপর্যয়ের একটি উদ্বেগজনক চিত্র।
বারসিক উপকূলীয় অঞ্চলের সহযোগী আঞ্চলিক সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণ জোয়ারদার এর সভাপতিত্বে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেন বারসিকের কর্মসূচী কর্মকর্তা মোঃ মফিজুর রহমান। তিনি তার বক্তব্যে আরও বলেন, কীটনাশক ব্যবহারের কারণ ও উৎস খুজঁতে গিয়ে আমরা জানতে পেরেছি ধান ও সবজি ফসলে মাজরা পোকা, লেদা পোকা, জাব পোকা, ছিদ্রকারী পোকা এবং বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগ দমনের লক্ষ্যে কীটনাশকের ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রচলিত কীটনাশক হিসেবে কৃষকরা এসাটপ, কট, ভিত্তাক, এ্যমিস্টার টব, ডেল এক্সপার্ট, ইনসিপিও, তুবা, সাম, তালাফ, গম বিষ, কালো গুড়া বিষ, সবিক্রম, এন্টাকল, ক্যারাটে, তাসলা, ফোলিকুর, জোয়াস, রিপকট, জাহিম, (ফার্মকট, মিমটক্স, কনজাপ্লাস, বাইফোরান, কারবেন্ডাজীম+ম্যানকোজেব, মর্টার- এই গুলো সরকারী ভাবে নিষিদ্ধ) এগুলো ব্যবহার করে আসছে।
শ্যামনগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে ব্যবহারকারীর পরিচয় ও মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা বলছে, কৃষকরা নিজেরাই এসব কীটনাশক প্রয়োগ করেছেন। কৃষক নজরুল ইসলাম, আজিজেল কয়াল, গহর কয়াল, গোপাল মন্ডল, উত্তম মন্ডল, কেনা মন্ডল, প্রভাস মন্ডল, কওছার প্রমুখ কৃষকগণ প্রায় সবাই সরাসরি স্প্রে কাজে অংশ নিয়েছেন। সরাসরি কীটনাশক স্প্রে করার ফলে এসব কৃষকদের চোখে চুলকানি, ছানি, ঝাপসা দেখা, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, হাত-পা ঝিনঝিন করা, শারীরিক দুর্বলতা, চর্মরোগ ও লিভারের জটিলতা দেখা দিয়েছে।
শুধু শারীরিক অসুস্থতা নয় এসব কৃষকরা আবার অর্থনৈতিক ভাবেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কোন কোন কৃষকের চিকিৎসার ব্যয় ৮০০ টাকা থেকে ৯০,০০০ টাকা পর্যন্ত গড়িয়েছে। অধিকাংশ পরিবারই নিজস্ব সঞ্চয় ও আত্মীয়দের সহায়তায় চিকিৎসা খরচ চালিয়েছেন। অনেকেই এখনো চিকিৎসাধীন। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রাণিজগতের ক্ষতি হিসেবে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ফসলি জমিতে বিষক্রিয়ার কারণে লাউ, বেগুন ইত্যাদি ফসলে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পুকুরের মাছ মারা গেছে। বাসাবাড়িতে তেলাপোকা মারতে গিয়ে শিশু ও বৃদ্ধরা আক্রান্ত হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষক মো. নজরুল ইসলাম, মো. খলিল গাজী, বারসিক এর কর্মসূচী কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিলন, যুব সংগঠক স.ম ওসমান গনী সোহাগ, কমিউনিটি ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর দিলরুবা ইয়াসমিন, শ্যামনগর উপজেলা প্রেসক্লাবের সাংবাদিক বৃন্দ প্রমুখ।
তারা আরও বলেন যে গবেষণায় এটা প্রতিয়মান হয় কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য নয়, বরং পরিবেশ ও গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এসব সমস্যা থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণের জন্য কীটনাশক ব্যবহারের আগে কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, কীটনাশকের লেবেলের ভাষা সহজীকরণ ও গণমাধ্যমে প্রচার করা, কীটনাশক স্প্রে করা কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতিবন্ধী কৃষকদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করা সহ বিকল্প নিরাপদ জৈব কৃষি পদ্ধতি ও স্থানীয় কৃষকদের জ্ঞানের প্রসার ঘটানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করার দাবী জানিয়েছে এই অঞ্চলের কৃষকরা।
ছবি- শ্যামনগর প্রেসক্লাবে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে লিখিত বক্তব্য রাখছেন বারসিক কর্মকর্তা মো: মফিজ।