ফুজিসান প্রোপার্টিজ লিঃ-এর ভুয়া বিজ্ঞাপনের ফাঁদ: বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় সতর্কবার্তা

রাজধানীর আবাসন খাতে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ‘ফুজিসান প্রোপার্টিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি। নিজেদের জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে দাবি করে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য—কাগজপত্রে এ ধরনের কোনো যৌথ বিনিয়োগের অস্তিত্ব নেই।
‘ফুজিসান গ্রীন সিটি’সহ একাধিক কথিত প্রকল্পঃ
ফুজিসান প্রোপার্টিজ লিঃ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের জিন্দা গ্রামে ‘ফুজিসান গ্রীন সিটি’ নামে একটি আবাসিক প্রকল্পের বিজ্ঞাপন চালাচ্ছে। পাশাপাশি তারা আরও দুটি প্রকল্পের প্রচারণা দিচ্ছে—
ফুজিসান টোকিও সিটি – কালিগঞ্জ
ফুজিসান ওসাকা সিটি – কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই কথিত তিনটি প্রকল্পের একটিরও কোনো সরকারি কাগজপত্র নেই।
নিবন্ধিত হলেও যৌথ বিনিয়োগের দাবি মিথ্যাঃ
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ (RJSC) সূত্রে জানা গেছে, ফুজিসান প্রোপার্টিজ লিঃ-এর ইনকর্পোরেশন নম্বরঃ সি-২০০৫১০/২০২৫ এবং ইস্যু নম্বরঃ৪৮৬১৮৮,
কোম্পানিটি ২০২৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধিত হয় মাত্র চারজন পরিচালক নিয়ে। তারা হলেন—
(১).মোঃ তরিকুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান,(২).মোঃ রেজাউল্লাহ রেজা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক,(৩).মোঃ নাজমুল হোসেন, পরিচালক এবং (৪).খালেদ মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ, পরিচালক
কোম্পানির অথরাইজড ক্যাপিটাল ২ কোটি টাকা, তবে পেইড-আপ ক্যাপিটাল মাত্র ৩০ লক্ষ টাকা।
তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই মালিকরা তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেননি, যা বড় ধরনের অনিয়মের ইঙ্গিত দেয়।
কোম্পানি নিবন্ধিত থাকলেও যৌথ বিনিয়োগের কোনো সরকারি নথি নেই। অর্থাৎ জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগের দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
ভুয়া বিজ্ঞাপনে জাপানি নাগরিকের নাম ব্যবহারঃ
বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞাপনে কোম্পানিটি দাবি করছে, তাদের চেয়ারম্যান জাপানের নাগরিক মিস্টার তমোকাজু মাকিনু। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই জাপানি নাগরিকের সঙ্গে কোম্পানির কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। কোনো সরকারি নথিপত্রেও এর প্রমাণ মেলেনি।
শুধুমাত্র গ্রাহকদের আকৃষ্ট ও প্রতারণার জন্য এই নাটক সাজানো হয়েছে।

অনুমোদনহীন প্রকল্প ও প্রশাসনের অবস্থানঃ
দাউদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক সিকদার আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন—
“আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ফুজিসান প্রোপার্টিজ লিঃ নামে কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।”
নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, খ অঞ্চল) টিএম রাহসিন কবির বলেন—
“ফুজিসান প্রোপার্টিজ লিঃ কোনো জমি অধিগ্রহণের আবেদন করেনি বা অনুমোদন নেয়নি। অনুমোদন ছাড়া কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। অভিযোগ পেলে আমরা সাথে সাথেই আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
কোম্পানির অবস্থানঃ
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোঃ রেজাউল্লাহ রেজা-র সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি।
পরবর্তীতে কোম্পানির একজন পরিচালক খালেদ মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন—
“আমরা মাত্র কয়েক মাস হলো কার্যক্রম শুরু করেছি। এখনো গোছগাছ করছি। অনুমোদন নেওয়া হয়নি, তবে ভবিষ্যতে নেব।”
অনুমোদন ছাড়া কেন বিপণন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোন কেটে দেন। একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও আর সাড়া পাওয়া যায়নি।
রাজউক ও বিশেষজ্ঞদের কড়া মন্তব্যঃ
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোঃ রিয়াজুল ইসলাম বলেন—
“স্থানীয় সরকার ও জেলা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের কার্যক্রম বেআইনি। আমরা শিগগিরই এ কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। পূর্বাচলে শত শত কোম্পানি নিবন্ধন ও ট্রেড লাইসেন্সের আড়ালে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে হবে।”
বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ) জানিয়েছে—
“ফুজিসান প্রোপার্টিজ লিঃ আমাদের কোনো সদস্য নয়।”
এছাড়াও ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান—
“কোম্পানিটি কোনো ধরনের জমি ক্রয় বা উন্নয়নের জন্য অনুমতি নেয়নি।”
পরিবেশবিদদের উদ্বেগঃ
পরিবেশবিদ ড. আফসানা মজুমদার বলেন—
“অনুমোদন ছাড়া জমি বিক্রির নামে প্রতারণা দেশের আবাসন খাতকে ধ্বংস করছে। প্রশাসনের উচিত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।”
স্থানীয় জমির মালিকদের গুরুতর অভিযোগঃ
স্থানীয় জমির মালিকরা অভিযোগ করেন—
“তারা কোনো জমি না কিনেই সন্ত্রাসী ভাড়া করে আমাদের জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। মামলার ভয় দেখিয়ে দখল করার চেষ্টা করছে।”
অভিযোগ আরও গুরুতর—
“সাবেক চেয়ারম্যানের বাড়ির পিছনে এবং তার নিজস্ব জমির উপর শুধুমাত্র সাইনবোর্ড বসিয়ে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করছে। প্রকৃতপক্ষে সাবেক চেয়ারম্যান ও আমরা কখনো এই জমি বিক্রি করবো না। এটি সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোকেরা করেছে, আর এর সাথে সাবেক চেয়ারম্যানের যোগসাজশ রয়েছে।”
দুদকের মন্তব্যঃ
দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) মীর মোঃ জয়নুল আবেদিন শিবলী আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন—
“এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে দুদক অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। যদি এই ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, অবশ্যই তাদের শাস্তি হবে।”
আইন বিশেষজ্ঞের সতর্কবার্তাঃ
ব্যারিস্টার কামরুল হাসান বলেন—
“জাপান-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগ হলে তা সরকারিভাবে অনুমোদন সাপেক্ষে হতে হবে। যেহেতু তাদের কোনো অনুমোদন নেই, এটি সম্পূর্ণ ভুয়া। প্রতারণার দায়ে এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র মামলা করতে পারে এবং শাস্তি হতে পারে।”