গাজীপুরে অনুমোদনবিহীন মারমেইড গ্রীন সিটি: সরকারি জমি দেখিয়ে কোটি টাকার প্রতারণা, গ্রাহকদের ক্ষোভে তোলপাড়

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে ‘পূর্বাচল মারমেইড গ্রীন সিটি’ নামে একটি প্রকল্পের আড়ালে চলছে ভয়াবহ প্রতারণা। জমির মালিকানা, সরকারি অনুমোদন ও মৌজা সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মারমেইড গ্রুপের বিরুদ্ধে।
কথিত কোম্পানির দাবিঃ
১,৫০০ বিঘার আবাসিক প্রকল্প, পাঁচটি ব্লক (এ, বি, সি, ডি ও ভিআইপি ব্লক), বিদ্যুৎ ও আধুনিক অবকাঠামোসহ একটি আদর্শ নগরী। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, এই প্রকল্পের কোনো অনুমোদন নেই।
প্রকল্পের অবস্থান ও অনুমোদনের অবস্থাঃ
মারমেইড গ্রুপের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে প্রকল্পটি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের পুবাইল এলাকায়, চঙ্গের বাইদ ও নন্দীবাড়ি মৌজায়। কিন্তু স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই এলাকায় উল্লেখিত মৌজা সমূহে বেশিরভাগ জমি সরকারি এবং কবরস্থানের জন্য ক্রয়কৃত জমি অন্তর্ভুক্ত করে মারমেইড গ্রুপ প্লট বিক্রির প্রচারণা চালাচ্ছে।
প্রশাসনের বক্তব্যঃ
গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল মান্নান আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন,
“মারমেইড গ্রুপ বা মারমেইড গ্রীন সিটি নামে কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প চালানো অবৈধ। আমরা শিগগিরই ব্যবস্থা নেব এবং সাধারণ মানুষকে প্রতারণা থেকে সাবধান থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।”
গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন বলেন,
“হাউজিং প্রকল্পের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে অনুমোদন বাধ্যতামূলক। মারমেইড গ্রুপ কোনো আবেদনই জমা দেয়নি। অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প চললে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
গ্রাহকদের ক্ষোভ
প্রকল্পে বিনিয়োগ করা তিনজন গ্রাহক আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন—
উত্তরার সাইফুল ইসলাম জানান,
আমি ৩ কাঠার প্লটের জন্য বুকিং দিই। টাকা দেওয়ার পর কাগজপত্র চাইলে তারা নানা অজুহাত দেখায়। এখন বলছে অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন, কিন্তু তিন মাস হয়ে গেছে।
মিরপুরের রুবিনা আক্তার বলেন,
সাইট ভিজিট করতে গেলে দেখি শুধু সাইনবোর্ড আর সাইনবোর্ড। আমাকে বিক্রয় প্রতিনিধি জানায়, সকল জমি কোম্পানি অনেক আগেই ক্রয় করে রেখেছে।আমি বিশ্বাস করে তিন কাঠা জমির সকল মূল্য পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করি কিন্তু ৬ মাস হয়ে গেল কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে না। আমি যার মাধ্যমে প্লট ক্রয় করেছি তিনিও এখন এই কোম্পানিতে নেই। বিক্রয় প্রতিনিধি বলেছেন দুই মাসের বেতন না দেওয়ার কারণে তিনি চাকুরি ছেড়ে চলে গিয়েছেন অন্য কোম্পানিতে।তিনি এটাও বলেছেন আমার টাকা রিফান্ড নেওয়ার জন্য।
পুরান ঢাকার আরেক গ্রাহক ইমরান হোসেন বলেন,
ভালো জায়গায় প্লট পাওয়ার আশায় বুকিং দিই। পরে বুঝতে পারি অনুমোদন নেই। ফোন করলে তারা ঘুরিয়ে কথা বলে। আমি এখন আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছি।
জমির মালিকদের অভিযোগঃ
স্থানীয় জমির মালিকরা জানান, কোম্পানি সাইট অফিসের জন্য জমি ভাড়া নিয়েছিল প্রতিমাসে টাকা দেওয়ার শর্তে। কিন্তু সেই টাকা আজও তারা পাননি। শামসুল আলম, আক্কাস আলী ও গেনদু মিয়া বলেন,
সাইনবোর্ড বসানোর জন্য আমাদের জমি ভাড়া নেয়। কিন্তু এক টাকাও দেয়নি। উল্টো আমাদের জমি দেখিয়ে অন্যের কাছে প্লট বিক্রি করছে। প্রশাসনকে অনুরোধ করছি এই প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।

কোম্পানির কর্মীদের অভিযোগঃ
মারমেইড গ্রুপের সাবেক বিক্রয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গ্রাহকরা বুকিং দেওয়ার পর কাগজ চাইলে কোম্পানি তা দিতে পারে না। কর্মকর্তারা বলতেন—কিস্তিতে বিক্রি হয়েছে, কাগজ লাগবে না।
তাদের দাবি, প্রায় ২০ জন বেতন না পেয়ে একসাথে চাকরি ছাড়ি। পরে লেবার কোর্টে মামলা করে বেতন পাই। তারা আরও যোগ করেন আমাদের বেতন দিতেই যদি কোম্পানি এরকম করে তাহলে গ্রাহকদের তো প্লট দিবে না এটাই প্রমাণ হয়।
কোম্পানির প্রতিক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নীরবতাঃ
মারমেইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হুদার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি প্রকল্পের অনুমোদনের ব্যাপারে প্রশ্ন করাতে ফোন কেটে দেন, পরে আর ফোন ধরেননি।
তবে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) রাকিবুল হাসান বলেন,
“আমরা বৈধভাবে ব্যবসা করছি। কিছু রেজিস্ট্রিতে দেরি হয়েছে, শিগগিরই সমাধান হবে।”
তবে সরকারি অনুমোদন না থাকার বিষয়ে তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব দেননি।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শঃ
রিয়েল এস্টেট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অনুমোদনপত্র যাচাই না করে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা জেলা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রকল্পে টাকা দিলে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ।