কোটি কোটি টাকার প্রতারণা! আবাসনের স্বপ্নে ছদ্মবেশী ‘রন’-এর ফাঁদে সর্বস্বান্ত বহু পরিবার

ঘরের স্বপ্ন মানেই সারা জীবনের সঞ্চয়। সেই স্বপ্নকে পুঁজি করে যখন কোনো প্রতারক মানুষের জীবনের সমস্ত শ্রম-ঘামে জমানো টাকা লুটে নেয়, তখন কত পরিবার যে পথে বসে—তার হিসাব কে রাখে!
এখন দেশের আবাসন জগতে এমনই এক আলোচিত প্রতারকের নাম উঠে এসেছে—রেজা আল মুরাদ (রন)। একের পর এক কোম্পানির আড়ালে ছদ্মবেশে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী।
চাকরি জীবনের শুরুতেই দুর্নীতি আর শ্লীলতাহানি
অনুসন্ধান বলছে, রন প্রথমে ঢাকার প্লাটিনাম গ্রুপ-এ বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকুরি শুরু করেছিলেন। সেখানেই আর্থিক অনিয়ম আর নারী সহকর্মীদের শ্লীলতাহানির অভিযোগে তাকে বিতাড়িত হতে হয়।
এরপর রন যান অক্টাগন অ্যাসেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড-এ এজিএম পদে।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামিন বিল্লাহ মাসুম আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন—
রেজা আল মুরাদ কিছুদিন আমাদের এখানে কাজ করেছেন। কিন্তু আর্থিক দুর্নীতি আর চারিত্রিক সমস্যা থাকার কারণে তাকে বিদায় করতে হয়।
পরবর্তী পদক্ষেপে রন স্বনামধন্য এ্যাম্পায়ার গ্রুপ-এ গিয়ে জিএম হিসেবে যোগ দেন।
গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ জুয়েল রানা বলেন—
রনকে জিএম হিসেবে নিয়েছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে সে আমাদের এক বিক্রয়কর্মীকে অনৈতিক প্রস্তাব দেয়। বিষয়টি মামলার পর্যায় পর্যন্ত গড়ায়। পরে আর দেরি না করে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করি।
ভুয়া মানি রিসিটের ছক—অফিসের আড়ালে ব্যক্তিগত লুটপাট
ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে বড় ক্ষোভ হলো রনের ভুয়া মানি রিসিটের ফাঁদ।
তিনি যখন যে কোম্পানিতে থাকতেন, তখন গ্রাহকদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সখ্যতা গড়ে তুলতেন। অফিসের বাইরে নিজেই বানানো ভুয়া রিসিট দিয়ে টাকা নিতেন, যা দেখতে হুবহু অফিসের আসল রিসিটের মতো!
যখন গ্রাহকরা সেই রিসিট নিয়ে অফিসে আসতেন, কোম্পানি জানাতো—
এমন কোনো রিসিট আমরা ইস্যু করিনি!
ফলে সাধারণ মানুষের টাকা গায়েব, অভিযোগের কোনো লিখিত প্রমাণ নেই—এভাবেই একের পর এক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে।
পরিচয় বদলিয়ে নতুন ফাঁদ—‘মেগা টাউন’ প্রকল্প
সব কোম্পানিতে অনিয়ম ধরা পড়লে রন লুকিয়ে নতুন কোম্পানিতে যুক্ত হতেন।
সর্বশেষ তিনি বন্ধ হয়ে যাওয়া মেগা বিল্ডার্স-এর এক সাবেক কর্মকর্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে শুরু করেন ‘মেগা টাউন’ প্রকল্প। অভিযোগ আছে, প্রকল্পের নামে এক শতাংশ জমিও কোম্পানির নয়!
কিন্তু চোখধাঁধানো স্বপ্ন দেখিয়ে ভুয়া রিসিট আর কথার জোরে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ কোম্পানি থেকেও তিনি চলে গেছে গত ১৩ মার্চ ২০২৫.
নারী সহকর্মী ও ক্লায়েন্টদের টার্গেট
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য অনুযায়ী, রনের আরেকটি কৌশল ছিল সরলমনা নারী কর্মী বা ক্লায়েন্টকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ফাঁসানো।
কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, তিনি এক ডজনেরও বেশি নারীকে বিয়ের ফাঁদে ফেলেছেন—এমনকি এক খ্রিস্টান নারীও তার ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি।

অফিসে প্রকাশ্যে জুতাপেটা!
রনের স্ত্রী একসময় তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অফিসেই প্রকাশ্যে জুতাপেটা করেন! পরে ‘মেগা টাউন’ প্রকল্পের অফিসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
এই দৃশ্যের ভিডিও ফুটেজ আবাসন নিউজ২৪-এর কাছে সংরক্ষিত আছে।
নতুন ফাঁদ—‘কোম্পানি খুলে দেওয়ার’ নামে লোভ!
সাম্প্রতিক অভিযোগে উঠে এসেছে, রন শুধু ভুয়া প্রকল্প নয়, ‘কোম্পানি খুলে দেওয়ার’ নামেও ফাঁদ তৈরি করেছেন।
ভুক্তভোগী সেলিম আহমেদ অভিযোগ করেছেন,
রন পূর্বাচলে প্রকল্প করে দেবে বলে তার কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছেন। দীর্ঘদিনেও কোনো কাজ শুরু হয়নি—শুধু নানা অজুহাত!
এভাবেই নতুন নতুন গল্প বানিয়ে কারো কাছে বলেন, আপনাকে কোম্পানির মালিক বানিয়ে দেবো।
এতে কেউ হয়তো লোভে পড়ে বিনিয়োগ করে, পরে বুঝতে পারে সর্বস্ব গেছে।
গ্রামের বাড়ি নওগাঁতে
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতারক রেজা আল মুরাদ (রন)-এর গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলার নওগাঁ সদর উপজেলার নওগাঁ পৌরসভার ভাঙ্গাবারিয়া গ্রামে।
রনের বক্তব্য মিলল না
রনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিনিয়োগকারীদের জন্য মানবিক সতর্কবার্তা
শত শত পরিবার আজও তার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব। ভুক্তভোগীদের একটাই অনুরোধ—
এমন প্রতারকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক—যাতে আর কেউ ঘর হারিয়ে পথে না বসে।