
স্বৈরাচারী সরকারের সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং তাঁর প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ‘নর্থ সাউথ গ্রুপ’ এখন একটি ভয়ঙ্কর প্রতারক সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে।
রাজধানীসংলগ্ন নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির একের পর এক প্রকল্প ঘিরে উঠে এসেছে ভয়াবহ অভিযোগ—জমি দখল, অবৈধ বালু ভরাট, ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রতারণা, নারী নির্যাতন এবং প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারের মতো গুরুতর অপরাধ।
রূপগঞ্জে ‘নর্থ সাউথ গ্রীন সিটি’: জমি দখল ও ভীতিকর পরিবেশ
রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিস্তৃত ‘নর্থ সাউথ গ্রীন সিটি’ প্রকল্প নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ তুলেছেন জমির মালিক শহিদুল, ক্ষইমুদ্দিন, আমিনুল, জুলহাসসহ বহু ভুক্তভোগী। তারা জানান, কোম্পানিটি অল্প টাকায় বায়না করে জমি দখল করে রাখে বছরের পর বছর—রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই। টাকা চাইলে হুমকি, মামলা, এমনকি হত্যার ভয় দেখানো হয়।
প্রকল্পটি ভুলতা, শান্তিনগর, কইরাবো, শোনাবো, আউখাব, মিরকিচা, মাঝিপাড়া ও মাছিপুর মৌজায় বিস্তৃত।

৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মজিবুর রহমান বলেন,আমি এই কোম্পানি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এদের পেছনে বড় বড় লোক আছে। একবার একটি মাদ্রাসার জলাশয় ভরাটে প্রতিবাদ করেছিলাম, আমাকে তখন বিভিন্নভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। এখন ভয়েই চুপ করে আছি। আপনারা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন।
ভুলতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আরিফুল হক ভূঁইয়া জানান,বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কোম্পানিটি ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকাবাসীকে চুপ করিয়ে রেখেছে। আমরা এবার প্রশাসনকে অবগত করছি যেন জমি ও জলাশয় দখল বন্ধ করা হয়।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করতে গাজী টিভির মনোগ্রামযুক্ত গাড়ি ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি।
শ্রীনগরে ‘নর্থ সাউথ স্কয়ার সিটি’: গোলাগুলি, হুমকি ও জমি দখল
ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের পাশে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বাড়িগাঁও, বেজগাঁও, বাশাইলভোগ, হোগলগাঁও ও নাগরভাগ মৌজায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রকল্পেও রয়েছে ভয়াবহ সব অভিযোগ। জমি দখলের সময় গোলাগুলির ঘটনা, হুমকি এবং জোর করে ব্যানার না দেয়া পর্যন্ত জমি ফেরত না দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
জমির মালিক জহির উদ্দিন বলেন,ভয় দেখাতে কোম্পানির নির্দেশে নিজেরাই ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে। এরপর সবাই চুপ।
শ্রীনগর ইউএনও মোঃ মহিন উদ্দিন বলেন,
গোলাগুলির অভিযোগ শুনেছি। আবার এমন ঘটনা ঘটলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভূমি দখলের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হবে।
গাজীপুরে ‘নর্থ সাউথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি’: হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জলাশয় ভরাট
গাজীপুর সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলার পরিবেশ সংবেদনশীল বেলাই বিল এলাকায় হাইকোর্ট ও জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও চলছে নির্মাণ ও বালু ভরাট। এই প্রকল্পটি পুবাইল শিমুলিয়া এলাকায় বেলাই বিলের সীমানায় অবস্থিত।
অভিযোগ উঠেছে, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ও গাজীপুর-৫ আসনের সাবেক এমপির ক্যাডাররা প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
সদর ইউএনও মোঃ মামুনুর রশীদ জানান,
এই প্রকল্পে কোনো অনুমোদন নেই। আমরা কয়েকবার কাজ বন্ধ করেছি, নোটিশও দিয়েছি। তারপরও দুর্বৃত্তদের সহায়তায় কাজ চলছে। আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
কালীগঞ্জ ইউএনও তনিমা আফরাদ বলেন,
আইনের ঊর্ধ্বে কেউ না। বালু ভরাটের খবর পেলে তাৎক্ষণিক অভিযান চলছে। জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানানো হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আরেফিন বাদল বলেন,
নর্থ সাউথ গ্রুপ বেলাই বিলে অবৈধভাবে বালু ভরাট করছে। তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেব। জলাশয় ভরাট করে কোনো আবাসিক প্রকল্প গড়া সম্ভব নয়।

‘নিরাপদ ভ্যালি’ প্রকল্প: প্রতারণার নতুন কৌশল
রাজধানীর জলশিরি আবাসনের পাশে ‘নিরাপদ ভ্যালি’ নামের একটি প্রকল্পে সামান্য জমিতে সাইনবোর্ড বসিয়ে, অন্যের বাসা ভাড়া নিয়ে সাইট অফিস দেখিয়ে, ৫০% ডিসকাউন্টে ফ্ল্যাট বিক্রির নামে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে।
জমির মালিক এরশাদ হোসেন বলেন,
আমাদের জমিতে জোর করে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। ক্যাডার দিয়ে ভয় দেখায়।
আনোয়ার হোসেন বলেন,
প্রতিবাদ করায় পুলিশ দিয়ে হুমকি দিয়েছে। এখন চুপ করে আছি।
রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোঃ রিয়াজুল ইসলাম বলেন,
এই প্রকল্পে আমরা চিঠি দিয়েছি। তদন্ত চলছে। জমি দখলের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সামরিক পরিচয় ও পুলিশের বিনিয়োগ: প্রতারণার প্রভাব বিস্তার
প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুজুর রহমানকে সিইও পদে নিয়োগ দেয়। অভিযোগ, সামরিক পরিচয় ব্যবহার করে প্রশাসন ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
সাবেক সি আর কর্মকর্তার চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস
নর্থ সাউথ গ্রুপের সাবেক সিআর কর্মকর্তা আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন,
নর্থ সাউথ গ্রুপে বিনিয়োগ করে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের লেনদেনের তথ্য মুছে ফেলতে মৌখিকভাবে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়। আমি অস্বীকার করি, কারণ এতে আমার স্বাক্ষর ছিল। এরপরই আমাকে মিথ্যা অভিযোগে চাকরি থেকে বের করে দেয়।
তিনি আরও বলেন,
অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখানে তাদের কালো টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আলোচিত সাবেক ডিবি (গোয়েন্দা পুলিশ) প্রধান ও তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদ এবং তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম), ডিএমপি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার-সহ আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার নাম আমি জানি—যারা নর্থ সাউথ গ্রুপে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অর্থ লগ্নি করেছিলেন। এই কোম্পানিটি একই প্লট একাধিকবার বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। আমি রাষ্ট্রীয় তদন্তের মাধ্যমে এসব অবৈধ বিনিয়োগ ও অর্থ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরতের দাবি জানাই।
নারী কর্মীদের ওপর অনৈতিক আচরণ
নর্থ সাউথ গ্রুপের হেড অব সেলস মাহবুবুর রহমান খান (বর্তমানে ডিএমডি)-এর বিরুদ্ধে নারী কর্মীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ইনসেন্টিভ আটকে রেখে হোটেলে যেতে বাধ্য করা, ভিডিও কল করা ইত্যাদি ন্যক্কারজনক আচরণ করেছেন।

ছবি: সংগৃহীত
একজন নারী কর্মী বলেন,
বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার ছিল। কিন্তু ইনসেন্টিভ আটকে রেখে আমাকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়েছে।
নারী অধিকারকর্মী রোকসানা বেগম বলেন,
এটি জঘন্য অপরাধ। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রতারণার শিকার শত শত পরিবার:
কান্নায় ভেঙে পড়া ভুক্তভোগী গ্রাহক আলতাফ হোসেন জানান,
১০ লক্ষ টাকার তিনটি চেক দিলেও একটিও পাশ হয়নি। এখনো ঘুরছি।
৩১ জন গ্রাহক জানান,
প্লটের টাকা পুরো পরিশোধ করেও রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছি না। এখন বলে, আরও টাকা না দিলে হবে না। টাকা ফেরত চাইলে দরখাস্ত দিতে বলে, পরে ১০–১৫% কেটে নিয়ে ৬ মাসের মধ্যে ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দেয়।
সাবেক কর্মচারীরা বলেন,
চাকরি ছাড়ার পর কমিশন আটকে রেখে বনানী থানার সহায়তায় মিথ্যা জিডি করে হয়রানি করেছে।

বিতর্কিত মন্তব্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালক
নর্থ সাউথ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম ইউসুফ আবাসন নিউজ২৪-কে বলেন,
আপনারা যা খুশি লিখেন, সমস্যা নেই। বহু মিডিয়া আমাদের নিয়ে নিউজ করে পরে ডিলিট করেছে। আপনারাও লেখেন, আমরা দেখে নেবো।
উল্লেখ্য, এর আগে দৈনিক যুগান্তর-সহ দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে নর্থ সাউথ গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জমিদখল এবং অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও পরে তা রহস্যজনকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে নানারকম প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি: তদন্ত ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ দরকার
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই প্রতারক চক্রকে তদন্তের আওতায় এনে অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনা দরকার। সামরিক ছত্রছায়া ও রাজনৈতিক প্রভাবকে ঢাল বানিয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রতারণা করছে।
এত গুরুতর অভিযোগের পরেও প্রশাসনের শক্তিশালী হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
আকুল আবেদন: ভুক্তভোগীদের কান্না যেন রাষ্ট্রের কর্ণকুহরে পৌঁছায়
জমি হারানো কৃষক, সর্বস্ব হারানো গ্রাহক, অপমানিত নারী কর্মীদের কান্না আজ রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এখনই সময়, এই প্রতারক সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর।
ভুক্তভোগী গ্রাহক ও জমির মালিকরা মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন—
ক্যাডার বাহিনী দিয়ে এখনো অবৈধভাবে জমি দখল করছে। প্রতিবাদ করলেই মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এরা স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দোসর—তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই