
তীব্র গরমের এই মৌসুমে যখন বিদ্যুতের চাহিদা তুঙ্গে, তখনই দেশজুড়ে দেখা দিয়েছে চরম লোডশেডিংয়ের দুর্ভোগ। দিনের পর দিন বিদ্যুৎ নেই, শহর-গ্রাম কোথাও রেহাই নেই, তবে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। বিদ্যুৎ না থাকায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পুকুরের পানি তুলে মাছ চাষ, ক্ষেতে সেচ দেওয়া কিংবা ছোট ছোট কল-কারখানার উৎপাদন।
বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই। ফলে উৎপাদন হচ্ছে সীমিত, আর সেটুকুও সব জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রায় ২৬,৯০০ মেগাওয়াট হলেও বাস্তবে জ্বালানি ঘাটতির কারণে উৎপাদন নেমে এসেছে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের নিচে। বিশেষ করে সন্ধ্যার সময়, যেটিকে ‘পিক আওয়ার’ বলা হয়, তখন চাহিদা আরও বেড়ে যায়, অথচ অনেক কেন্দ্রেই উৎপাদন সম্ভব হয় না।
গত বছর (৩০ এপ্রিল ২০২৪) দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৬,৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড গড়লেও, সেটাও ছিল মাত্র এক ঘণ্টার জন্য। বর্তমানে দেশের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক কম, যার ফলে লোডশেডিং বেড়েই চলেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) জানায়, দেশে এখন বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির। শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলেরই ৫০ লাখের মতো গ্রাহক রয়েছে, যাদের গ্রীষ্মকালীন বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট। অথচ এ অঞ্চলে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৬৪০ মেগাওয়াট, যার বড় একটি অংশ আবার সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ায় বিকালের পর বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই অঞ্চলের বিদ্যুৎ আনা হয় অন্য অঞ্চল থেকে।
ঠিক এমন অবস্থাই উত্তরবঙ্গেও। রংপুর অঞ্চলে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বড় কেন্দ্র কয়লাভিত্তিক। তবে বছরজুড়েই এই কেন্দ্রটির কয়লা সংকট কিংবা সংস্কার কাজ চলায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই কারণেই রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে লোডশেডিং যেন নিয়তই সঙ্গী।
পিডিবির প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রাজশাহী শহরগুলোতে লোডশেডিং যতটা সম্ভব সীমিত রাখা হবে। তবে গ্রামাঞ্চলে এই সংকট আরও প্রকট হতে পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে প্রযুক্তিগত ত্রুটি, ট্রান্সমিশন লাইনের দুর্বলতা ও জ্বালানি সংকট—সব মিলিয়ে লোডশেডিং কিছুটা বাড়তে পারে। গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে, সেজন্য প্রস্তুত থাকা হচ্ছে।
এদিকে, জ্বালানি খাতে বিশ্লেষক ও ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলছেন, “দেশীয় গ্যাসের জোগান না বাড়াতে পারলে, বিদেশ থেকে কয়লা বা গ্যাস কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান হবে না। এটা আমাদের সামর্থ্যের বাইরে।”
পেট্রোবাংলা ইতোমধ্যে এলএনজি আমদানির জন্য সরকারের কাছে ২৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে, অথচ আগের সরকারের সময় এই খাতে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে, যা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান চিত্র বলছে, সামনে হয়তো তাপমাত্রা আরও বাড়বে, আর তার সঙ্গে লোডশেডিংও। তাই বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।