রাজধানীসহ সারাদেশে রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের হত্যা করে দেশজুড়ে অস্থিরতা তৈরির পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল সুব্রত বাইন ও তার বাহিনী। তাদের টার্গেটে ছিল বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতারা। এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সুবিধাজনক অবস্থানে আনা। গোয়েন্দা তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, এই ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে জড়িত ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নিষিদ্ধ নেতা।
এই গোপন পরিকল্পনায় সুব্রত বাইনের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ। হুন্ডির মাধ্যমে প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে বিপুল অর্থ এনে তা ব্যবহার করা হচ্ছিল পেশাদার শ্যুটার ও কিলার নিয়োগে। এসব তথ্য উঠে এসেছে তাদের রিমান্ডে দেওয়া জিজ্ঞাসাবাদে।
মঙ্গলবার রাতে হাতিরঝিল থানার অস্ত্র মামলায় সুব্রত বাইনকে ৮ দিন এবং মোল্লা মাসুদসহ বাকি তিন আসামিকে ৬ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি। আদালতের আদেশে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয় ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসাইনের আদালতে।
আসামিরা হলেন—সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, আরাফাত ইবনে নাসির ওরফে শ্যুটার আরাফাত এবং এমএএস শরীফ। আদালতে হাজিরের সময় কঠোর নিরাপত্তায় হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে তাদের আনা হয়।
আদালতে দাঁড়িয়ে সুব্রত বাইন সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “সত্য লিখবেন, যা দেখেছেন তাই লিখবেন। আমারও পরিবার আছে। ১৯৮৭ সাল থেকে কোনো প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আয়নাঘরে বন্দি থাকা, রড দিয়ে মারধরের ঘটনা কেউ জানে না।”
রিমান্ড শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক বলেন, আসামিদের কাছ থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের রিমাণ্ডে রেখে আরও অস্ত্র ও সহযোগীদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ বাদল মিয়া জামিন চেয়ে বলেন, “সুব্রত বাইন আজ মিডিয়ার সৃষ্টি। তাকে একাধিকবার ভারতে গ্রেফতার করা হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশে তার নাম তালিকাভুক্ত হয়।”
রিমান্ডে নেওয়ার পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা চার আসামিকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। শ্যুটার আরাফাত ও শরীফ প্রথমে অস্ত্র ও গুলির ব্যাপারে তথ্য দেন। তারা জানান, সীমান্ত এলাকা থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র ঢাকার মগবাজার, শাহবাগ, গুলশান ও বাড্ডার সন্ত্রাসীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এসব সন্ত্রাসীরা সম্প্রতি সুব্রত বাইন ও মাসুদের দলে যোগ দেয়। তাদের তালিকায় বেশিরভাগই উঠতি বয়সী এবং সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির সদস্য।
জিজ্ঞাসাবাদে সুব্রত ও মাসুদ জানান, তারা রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল—টার্গেট কিলিংয়ের পর এক দলের নেতাকে অন্য দলের দায়ে অভিযুক্ত করে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করা, যাতে আওয়ামী লীগ সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে।
তারা আরও জানান, প্রতিবেশী দেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের কয়েকজন নিষিদ্ধ নেতা নিয়মিতভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন। এই টাকা যশোর, কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ সীমান্ত দিয়ে লেনদেন হতো। কুষ্টিয়ায় তাদের একটি বড় আস্তানাও ছিল, যেখান থেকে ঢাকায় বহু অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে।
এক পর্যায়ে গোয়েন্দারা জানতে চান—বিএনপির সমর্থক হয়েও কেন আওয়ামী লীগের হয়ে মিশনে নামলেন? জবাবে সুব্রত বলেন, “২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরই আমাকে তালিকাভুক্ত করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। এরপর বিএনপির সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারিনি। বরং তারা আমাকে এড়িয়ে চলে। তাই আমি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলি এবং বিএনপিসহ সমমনাদের টার্গেট করি।”