মঙ্গলবার, ১৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ব্যানার পাল্টে প্রকল্প দখল! রাজ সিটি থেকে ল্যান্ডমার্ক টাউন

নিজস্ব প্রতিবেদক|আবাসন নিউজ২৪.কম

ল্যান্ডমার্ক টাউন

ছবিঃ ল্যান্ডমার্ক টাউনে ১০০ কাঠা প্লট বিক্রির জন্য অনুষ্ঠান।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের জিন্দা, পলখান ও তিন ওলোপ এলাকায় ‘ল্যান্ডমার্ক টাউন’ নামে একটি কথিত হাউজিং প্রকল্পকে কেন্দ্র করে জমি দখল, হুমকি-ধমকি এবং নানা অনিয়মের অভিযোগে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য—প্রকৃত জমির মালিকদের অজান্তে বা সম্মতি ছাড়াই জমিতে ব্যানার বসিয়ে প্রকল্পের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন জমির মালিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, অন্যদিকে প্রশ্ন উঠেছে—এই প্রকল্পের পেছনে আসলে কারা, এবং তাদের উদ্দেশ্যই বা কী?

‘রাজ সিটি’র ব্যানার ছিঁড়ে বসানো হয় ‘ল্যান্ডমার্ক টাউন’-এর সাইনবোর্ড

স্থানীয় রাজবংশীয় পরিবারের সদস্য মুজিবুর রহমান রাজ ও জহিরুল ইসলাম রাজ জানান, তারা তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে ‘রাজ সিটি’ নামে একটি আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিলেন। সেখানে ছিল রাজ সিটির নিজস্ব ব্যানার ও সাইনবোর্ড।

তাদের অভিযোগ, হঠাৎ একদিন সাবেক ওয়ার্ড মেম্বার বেলায়েত হোসেন ও তার অনুসারীরা এসে রাজ সিটির ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন এবং সেখানে জোরপূর্বক ‘ল্যান্ডমার্ক টাউন’-এর ব্যানার বসিয়ে দেন। বাধা দিতে গেলে রাজ পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে এবং রাজনৈতিক অপবাদ দিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

“জমি বিক্রি করিনি, তবু বলছে বিক্রি হয়ে গেছে”— জমির মালিকদের কান্নাজড়িত কণ্ঠ

স্থানীয় কৃষক ও জমির মালিকদের বক্তব্য, তারা এখনো জমি বিক্রি করেননি। অথচ সেই জমিগুলোর চারপাশে নানা ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

এক বৃদ্ধ কৃষক আবেগ জড়িত কণ্ঠে বলেন, “জমি আমাদের একমাত্র সম্বল। কেউ এসে বলছে এটা বিক্রি হয়ে গেছে, অথচ আমরা তো কলমই ধরিনি!”

প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ

সাবেক ওয়ার্ড মেম্বার বেলায়েত হোসেনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে জমি চিহ্নিত করছেন, ব্যানার বসাচ্ছেন এবং জমির প্রকৃত মালিকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।

স্থানীয়রা যাদের নাম প্রকাশ্যে এনেছেন:
(১) মৃদুল, পিতা: মৃত মহসিন (জিন্দা গ্রাম)
(২) মুন্না আকন্দ, পিতা: শাহাবুদ্দিন (জিন্দা গ্রাম)
(৩) মাসুম, পিতা: আফাজ উদ্দিন (জিন্দা গ্রাম)
(৪) জামাল মোল্লা, পিতা: রুস্তম মোল্লা (পলখান গ্রাম)

তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ আখ্যা দিয়ে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়।

আরও পড়ুন  আইজিপির সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ

ইউনিয়ন সচিব বললেন: “পর্যাপ্ত জমিও নেই, অনুমোদন তো দূরের কথা!”

দাউদপুর ইউনিয়নের সচিব শামীম মিয়া বলেন, “আমরা ল্যান্ডমার্ক টাউন নামের কোনো প্রজেক্টকে এনওসি দেইনি। যে জায়গার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে হাউজিং প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি নেই। আমার ব্যক্তিগত মত, এই প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।”

ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক শিকদার জানান, “প্রকল্পের জন্য কেউ আমাদের কাছে কোনো কাগজপত্র দেয়নি, অনুমোদনের জন্য আবেদনও করেনি।”

ল্যান্ডমার্ক টাউনের স্ববিরোধী বক্তব্য: মুখে বলেন বিক্রি শুরু হয়নি, অথচ ফেসবুকে ১০০ কাঠা বিক্রির উদযাপন!

‘ল্যান্ডমার্ক টাউন লিমিটেড’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শরিফুল ইসলাম খন্দকার জানান, “আমরা কয়েক বিঘা জমি ক্রয় করেছি এবং কিছু জমির বায়না করা হয়েছে। এখনো প্লট বিক্রি শুরু হয়নি, কেবল প্রকল্প ভিজিট করা যাচ্ছে।”

 

কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রকল্পটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ‘১০০ কাঠা জমি বিক্রি সম্পন্ন’—এমন লেখা সম্বলিত উদযাপনের একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এতে প্রশ্ন উঠছে—যখন বিক্রি শুরুই হয়নি বলে দাবি করা হচ্ছে, তখন ‘১০০ কাঠা বিক্রির উৎসব’ উদযাপন সাধারণ গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করার ফাঁদ নয় কি?

ভিন্ন দাম দেখিয়ে ফাঁদ পাতার অভিযোগ: জমির প্রকৃত দাম ৮-১০ লক্ষ, অথচ বিজ্ঞাপন মাত্র ৫ লক্ষ!

স্থানীয় জমির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিন্দা, পলখান ও তিন ওলোপ এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির প্রকৃত বাজারমূল্য ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা। অথচ ‘ল্যান্ডমার্ক টাউন’ তাদের ফেসবুক বিজ্ঞাপনে প্রতি শতাংশ জমির দাম দেখাচ্ছে মাত্র ৫ লক্ষ টাকা।

বিশ্লেষকদের মতে, এটিই এই প্রকল্পের মূল প্রতারণার চাবিকাঠি। কম দামে জমি পাওয়ার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। প্রকৃত মালিকের কাছ থেকে জমি না কিনেই কিংবা জমি হস্তান্তরের কোনো প্রক্রিয়া ছাড়াই ব্যানার ও প্রচারণা চালিয়ে একটি কৃত্রিম বিশ্বাসের জাল তৈরি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন  ইসলামে সুশাসন ও ন্যায়পরায়ণতা

পরিচালনা পর্ষদের অতীত পরিচয় নিয়েও প্রশ্ন

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ‘ল্যান্ডমার্ক টাউন লিমিটেড’-এর পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন:

১. মোঃ শরিফুল ইসলাম খন্দকার (ব্যবস্থাপনা পরিচালক)
২. সিকান্দার আলী (চেয়ারম্যান)
৩. মোঃ মশিউর রহমান (পরিচালক)
৪. মোঃ মাহফুজুর রহমান (পরিচালক)
৫. মোঃ নাহিদ হক (পরিচালক)
৬. মোঃ রেজা আল মুরাদ (রণ) (পরিচালক)
৭. আসিফ হাসান (পরিচালক)

পরিচালকদের মধ্যে তিনজন পূর্বে “মেগা বিল্ডার্স লিমিটেড”-এ গ্রাফিক ডিজাইনারসহ সাধারণ কর্মকর্তা ছিলেন। হঠাৎ করে তারা একটি কোম্পানির পরিচালক হয়ে ওঠেন—এটা কীভাবে সম্ভব, সে প্রশ্নও উঠছে। অভিযোগ রয়েছে, মোঃ নাহিদ হক ইতোমধ্যেই ‘ল্যান্ডমার্ক টাউন’ ছেড়ে নতুন একটি প্রকল্প ‘মাদানী সিটি’তে কাজ শুরু করেছেন।

প্রশ্ন নয়, এটি জীবিকা, নিরাপত্তা ও আত্মমর্যাদার লড়াই

এই ঘটনা শুধু একটি হাউজিং প্রকল্প নিয়ে নয়; এটি একটি গ্রামের জীবন, একটি পরিবারের পৈত্রিক সম্মান, এবং একটি সমাজের আত্মমর্যাদার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি।

স্থানীয়দের স্পষ্ট বক্তব্য—“আমরা জমি বিক্রি করিনি। তবু ব্যানার বসিয়ে বলা হচ্ছে, এটা এখন অন্যের! এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।”

WhatsApp
Facebook
Twitter
LinkedIn
Email
Telegram