শনিবার, ১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সেন্টমার্টিন দ্বীপে বিরাজ করছে দুর্ভিক্ষ, আতঙ্ক ও হতাশায় দ্বীপ ছেড়ে পালাচ্ছে মানুষ?

মোহাম্মদ ইউনুছ অভি টেকনাফ কক্সবাজার প্রতিনিধিঃ

সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। বালি, পাথর, প্রবাল কিংবা জীব বৈচিত্র্যের সেন্টমার্টিন ভ্রমণ পিপাসুমানুষের জন্য অনুপম অবকাশ কেন্দ্র। স্বচ্ছ পানিতে জেলি ফিশ, হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ, প্রবালসহ মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির অপার সৌন্দর্যে ভরা এই সেন্টমার্টিন। সম্প্রতি এই সেন্টমার্টিন নিয়ে শুরু হয়েছে লুকোচুরি

টেকনাফ থেকে ৩২কিলোমিটার দূরে সাগর বক্ষে অবস্থিত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এর চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আয়তন মাত্র ১৭ বর্গ কিলোমিটার হলেও প্রাকৃতিকভাবে কঠিন শীলায় গঠিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এছাড়াও অবস্থানগত কারণে ঝড় ঝাপটা দূর্যোগে শত শত বছর ধরে সুরক্ষিত সেন্টমার্টিন এর ভূখন্ড।

নারিকেল, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো ধান এই দ্বীপের প্রধান কৃষিজাত পণ্য। আর অধিবাসীদের প্রায় সবারই পেশা মৎস্য শিকার। তবে ইদানীং পর্যটন শিল্পের বিকাশের কারণে অনেকেই রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল কিংবা গ্রোসারি শপের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষ ধর্মপ্রাণ নিতান্ত সহজ-সরল, তাদের উষ্ণ আতিথেয়তা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। খুবই পর্যটন বান্ধব সেন্টমার্টিন এর মানুষ। প্রতি বছর পর্যটন মৌসুমে দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণ করে থাকেন। এই সুবাদে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্রিক অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গড়ে উঠেছে হোটেল মোটেল, পর্যটক যাতায়াতে যুক্ত হয়েছে এক ডজনেরও বেশী আধুনিক জাহাজ। পর্যটক সেবা ও সাগর থেকে আহরিত মৎস্য সম্পদ দিয়ে দ্বীপবাসীর জীবন জীবিকা ভালই চলত।
কিন্তু সম্প্রতি সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডে দ্বীপবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষ আতঙ্ক ও হতাশা। অন্তর্বর্তী সরকারের একের পর এক আসংলগ্ন ও রহস্যজনক সিদ্ধান্তের কারণে দ্বীপবাসীর মাঝে এই আতঙ্ক ও হতাশা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। প্রথমে সরকার মিয়ানমারের আরাকান সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতির অজুহাতে সেন্টমার্টিনের সাথে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়। অথচ নাফ নদী দিয়ে সেন্টমাটিনের যাতায়াত না হলেও বঙ্গোপসাগর দিয়ে জাহাজে সেন্টমার্টিন এর সাথে পর্যটক যাতায়াতে কোন ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা থাকে না। এছাড়াও গেল পর্যটন মৌসুমে কোন কারণ ছাড়া হঠাৎ করে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকেই সেন্টমার্টিনের সাথে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে করে পর্যটন ব্যবসায়ী, জাহাজ কোম্পানী ও সেন্টমার্টিন এর অধিবাসীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন চলছে সাগরে ৫৮ দিনের মাছধরার নিষেধাজ্ঞা। এতে করে দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ হয়ে পড়ে কর্মহীন বেকার। দ্বীপে এখন বিরাজ করছে চরম দুর্ভিক্ষ।

এছাড়াও সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের ভূখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও সেন্টমার্টিনের অধিবাসীদেরকে উপজেলা প্রশাসন এবং কোস্টগার্ড থেকে লিখিত অনুমতি নিয়ে কেন যাতায়াত করতে হবে বোধগম্য নয়। এতে করে দ্বীপের মানুষ অপমানিত বোধ করছে। এসব কারণে সেন্টমার্টিন এর অসংখ্য মানুষ টেকনাফ এবং কক্সবাজার পালিয়ে এসেছে।
জানা গেছে, গত ঈদুল ফিতরের সময় সেন্টমাটিনের মানুষ অভাব অনটনের কারণে ঠিকভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারেনি। চলতি এসএসসি পরীক্ষায় অভাবের কারণে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও আগামী ঈদুল আযহা উদযাপন কিভাবে করবে তার কোন হিসাব তারা মিলাতে পারছেনা বলে জানিয়েছেন সেন্টমার্টিনের অধিবাসীরা।

দ্বীপের সাবেক মেম্বার ও বর্তমান বাজার কমিটির সভাপতি হাবিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, দ্বীপে এখন চরম দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে। একদিকে পর্যটন মৌসুমে হঠাৎ করে পরিশের দোহাই দিয়ে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্যদিকে এখন সাগরে ৫৮ দিনের মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞা চলছে। এতে দ্বীপবাসী চরম অনটনে রয়েছে। হাসপাতালে ডাক্তার না থাকায় দ্বীপের মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছেনা বলেও জানান তিনি। দ্বীপের অসংখ্য মানুষ টেকনাফ এবং কক্সবাজারে কাজের সন্ধানে দ্বীপ ছেড়ে গেছে।

তিনি আরো বলেন বাংলাদেশের ভূখণ্ড হওয়া সত্ত্বেও সেন্টমার্টিন এবং সেন্টমার্টিন এর অধিবাসীদের নিয়ে সরকারের এ ধরনের আচরণ রহস্যজনক বলে তারা মনে করেন। স্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়া এই সিদ্ধান্ত সেন্টমার্টিনের দশ সহস্রাধিক জনগণের খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করারর শামিল।

মেম্বার হাবিবুর রহমান, নুরুল আলম, সংবাদ কর্মী সিদ্দিকুর রহমান ও রফিকুল আলম সহ অসংখ্য দ্বীপবাসী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সরকার আসলে সেন্টমার্টিনকে নিয়ে কি করতে চান এটা স্পষ্ট নয়। দ্বীপবাসীর মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তারা মনে করছেন এভাবে দ্বীপের মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দ্বীপ খালি করার কৌশল কিনা? তারা বলেন, এভাবে দ্বীপ খালি করে সেন্টমার্টিন অন্য কোন দেশের হাতে তোলে দেয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রচারণাও হচ্ছে দ্বীপবাসীর মাঝে। তারা আক্ষেপ করে বলেন, আর কত বিপর্যস্ত হলে সরকার এবং মিডিয়া সেন্টমার্টিনবাসীর খবর শুনবে?
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, সেন্টমার্টিন এর অধিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া বা সেন্টমার্টিন অন্য কারো হাতে তুলে দেয়ার বিষয়টি একটি গুজব। সরকার আসলে সেন্টমার্টিনকে একটি পরিবেশবান্ধব দ্বীপ হিসেবে সুরক্ষা করতে চায়।

পর্যটক নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিবেশের ক্ষতি না হয় মত সীমিত আকারে পর্যটক যাতায়াতের সুযোগ রেখেছে।

তিনি আরও বলেন, দ্বীপবাসীর ক্ষতি পোষাতে তাদের বিভিন্ন পেশায় জড়িত করার জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, মিয়ানমারের সাথে সরকারের করিডোর দেওয়ার যে পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যে জানা গেছে এর সাথে সেন্টমার্টিনের কোন যোগসূত্র আছে কি-না এবিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
সচেতন হলের মতে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান শেখ হাসিনা কথায় কথায় যেমন বলতেন, সেন্টমার্টিন লিখে দিলে তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। এখন প্রশ্ন উঠছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও এরকম কোন চাপে পড়েছে কিনা? নাহলে সেন্টমার্টিন নিয়ে এরকম লুকোচুরির কারণ কি?
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একে আহসান উদ্দীন বলেন, স্থানীয় লোকজনের যাতায়াতে কোন সমস্যা নেই। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের লোকজনকে অনুমতি নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। দ্বীপে দুর্ভিক্ষ প্রসঙ্গে ইউএনও বলেন, পর্যটক যাতায়াত বন্ধ হওয়ায় খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় তাদের জন্য বিভিন্ন সরকারী বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।
কেন সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ করা হলো এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান উদ্দিন বলেন, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য, বাঁচানোর জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পাঠক প্রিয়,

আপনিও আবাসননিউজ২৪.কম-এ ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি নিয়ে লিখতে পারেন।

আপনার লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ [email protected]