প্রতিদিনের শেয়ারবাজারে ধসঃ বিনিয়োগকারীদের হৃদয়ের আর্তনাদ—‘এ যেন পুঁজির রক্তক্ষরণ

প্রতিদিনের শেয়ারবাজারে ধসঃ বিনিয়োগকারীদের হৃদয়ের আর্তনাদ—‘এ যেন পুঁজির রক্তক্ষরণ
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার যেন কোনো অসুস্থ রোগীর মতো প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সূচক পড়ে যাচ্ছে নিয়মিত, আর সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বুকের ভেতর জমছে হতাশা, ক্ষোভ আর একরাশ ক্ষতি। কেউ কেউ বলছেন, এমন অবস্থা আগে কখনও দেখেননি—শেয়ারবাজার যেন বিনিয়োগকারীদের চোখের সামনেই গলাগলি করে মরছে।
নীতিমালার পাহাড়, কিন্তু সুফলের খরা
বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের নীতিমালা, নির্দেশনা আর বৈঠকের তোড়জোড় থাকলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মাঝে মাঝেই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে—কখনো লেনদেন সময় কমানো, কখনো নতুন আইন প্রণয়ন। অথচ বাজারের মূল চিত্রটা দিনকে দিন আরও ভয়াবহ হচ্ছে। সম্প্রতি সংস্থাটির ২২ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করার ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও তলানিতে পৌঁছেছে।
পুঁজিবাজারের সঙ্গে জড়িত এক প্রবীণ বিনিয়োগকারী কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে বলেন, “এই বাজারে এখন আর কেউ মুনাফার আশা করে না, শুধু ক্ষতির ভয় নিয়ে প্রতিদিন চার্ট দেখে। আমার ছেলের পড়াশোনার জন্য টাকা রেখেছিলাম শেয়ারে—এখন মূলধনই নেই। মুনাফা তো স্বপ্ন।”
বাজারে নেই তারল্য, নেই ভরসা
যারা ছোট ছোট পুঁজি নিয়ে শেয়ারবাজারে এসেছিলেন একটু আয় বাড়ানোর আশায়, তারা এখন পুরোপুরি কোণঠাসা। বাজারে তারল্যের অভাব, বড় বিনিয়োগকারীদের নির্লিপ্ততা, দুর্বল কোম্পানিগুলোর বাড়াবাড়ি লেনদেন—সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর চিত্র। কেউ কেউ বলছেন, শেয়ারবাজার এখন আর বিনিয়োগের জায়গা নয়, বরং ‘ভয়ংকর ফাঁদ’।
ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, “প্রতিদিন বাজার খুললে ভয় লাগে। শেয়ার কিনে মানুষ ঘুমাতে পারছে না। এমন একটা সময় এসেছে, যখন শেয়ারবাজার মানেই আতঙ্ক।”
—
আজকের ডিএসই: সূচক কমলেও লেনদেন কিছুটা বেড়েছে
৩০ এপ্রিল বুধবার, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রধান সূচক ১৭.৬৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৪,৯১৭ পয়েন্টে। তবে সামান্য ইতিবাচক দিক হলো, ডিএসই শরীয়াহ সূচক ০.২২ পয়েন্ট বেড়ে পৌঁছেছে ১,০৯৪ পয়েন্টে। অন্যদিকে ডিএসই-৩০ সূচক ১.৩৩ পয়েন্ট হারিয়ে নেমে এসেছে ১,৮২২ পয়েন্টে।
আজ মোট লেনদেন হয়েছে ৩২৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকার, যা আগের দিনের তুলনায় কিছুটা বেশি। আগের দিন লেনদেন ছিল ২৯১ কোটি ৭ লাখ টাকার।
আজ লেনদেন হওয়া ৩৯৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে:
দর বেড়েছে: ১৫৮টি
দর কমেছে: ১৭৬টি
দর অপরিবর্তিত: ৬২টি
—
সিএসইতে লেনদেন বেড়েছে চার গুণের বেশি, তবুও সূচকে পতন
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) আজ ৪১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে, যেখানে আগের দিন ছিল মাত্র ১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকার। অর্থাৎ লেনদেন বেড়েছে প্রায় চার গুণেরও বেশি।
তবে সূচকে তেমন ভালো খবর নেই। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ৯.৮৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১৩,৮০৫ পয়েন্টে। আগের দিন সূচক কমেছিল আরও বেশি—৩০.৫৭ পয়েন্ট।
সিএসইতে আজ লেনদেন হওয়া ২৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে:
দর বেড়েছে: ৮৮টি
দর কমেছে: ১১৬টি
অপরিবর্তিত রয়েছে: ২৯টি
সমাধানের খোঁজে বিনিয়োগকারীদের করুণ আকুতিঃ
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা চাইছেন, বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা যেন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়। আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন কেবল চাওয়া নয়, দেশের পুঁজিবাজার টিকিয়ে রাখার জন্য এটি জরুরি প্রয়োজন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারকে বাঁচাতে হলে লিপ সার্ভিস নয়—দরকার বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। তারল্য বাড়ানো, দুর্বল কোম্পানিগুলোর লেনদেন নিয়ন্ত্রণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক সূচক নয়—এটি হাজারো পরিবারের জীবনের স্বপ্ন, সঞ্চয় আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। এই বাজারে যদি প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ চলতেই থাকে, তবে শুধু বিনিয়োগকারীরা নয়—ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো অর্থনীতি