
রাজউক পূর্বাচল নিউ টাউনের ৩০ নম্বর সেক্টরের পাশের এলাকা সংলগ্ন —রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের কামতা মৌজার পলখান গ্রাম এবং কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের রাথুরা মৌজায় চলছে কথিত “মেগা টাউন” নামে হাউজিং প্রকল্পের বড় ধরনের প্রতারণা।
সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকায় ১০ থেকে ১২টি জমি অস্থায়ীভাবে ভাড়া নেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় জমির মালিকদের কোনো লিখিত সম্মতি ছাড়াই জবরদস্তিমূলকভাবে বসানো হয়েছে প্রকল্পের সাইনবোর্ড। ভুক্তভোগী গ্রাহকরা ব্যক্তিগতভাবে এলাকা ঘুরে এ অনিয়মের বিষয়টি জানতে পেরে পরে বিষয়টি আবাসন নিউজ২৪-কে অবহিত করেন।
তদন্তে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। জমির মালিকদের অনেকেই জানান, তাদের সম্মতি ছাড়াই সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে, এবং যে ভাড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে জমিতে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।জমির মালিকদের মধ্যে রয়েছেন রকমতুল্লাহ আকন্দ, হানিফ মোল্লা, জামাল মোল্লা, মেহেদী হাসান, নাহিদ আকন্দ, রাজু মোল্লা, শাহিন মিয়া, আনিসুল মিয়া, মহাব্বত আলি ও ইসাহাক ভূঁইয়া। তাদের ভাষ্যমতে—
এই জমি আমাদের নিজস্ব। শুরুতে বলা হয়েছিল মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দেওয়া হবে। পরে সেই ভাড়া বন্ধ করে ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাদের জমিতে সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। এখন আমরা নিজেরাই সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছি।
প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকার লেনদেন, কিন্তু জমির মালিকানা নেই
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মেগা বিল্ডার্স লিমিটেডের আওতায় পরিচালিত ‘মেগা টাউন’ প্রকল্পের জন্য এখন পর্যন্ত এক শতাংশ জমিও কেনা হয়নি।
স্থানীয়দের দাবি, কথিত “মেগা টাউন” প্রকল্পে যে দুটি মৌজার কথা উল্লেখ হয়েছে সে দুটি মৌজায় বিশ্বাস বিল্ডার্স লিমিটেড প্রকল্প এলাকার প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ জমি অনেক পূর্বেই ক্রয় করে রেখেছে। কিন্তু এই মেগা বিল্ডার্স নিজেদের ইচ্ছামত চকচকে গ্রাফিক ডিজাইনের লে-আউট প্ল্যান (এই লে-আউট প্ল্যানের কোন ভিত্তি নেই কারন আবাসন নিউজ২৪-যাচাই করে দেখেন গ্রাফিক্স ডিজাইনার দিয়ে ইচ্ছামত ডিজাইন করেছে) এবং পূর্বাচল রাজউক মডেল টাউনের পাশে এই প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়েছে। বাস্তবে কোনো জমির উন্নয়ন এর কাজ তো দূরের কথা , এক শতাংশ জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি।
স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য
দাউদপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক শিকদার আবাসন নিউজ২৪-কে জানান,
এই প্রকল্পের বিষয়ে আমার কাছে কেউ কোনো কাগজপত্র জমা দেয়নি। অনুমোদনের জন্য কেউ কোনো আবেদন করেনি। আমার পূর্বসূরির সময়েও কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। স্থানীয় সরকার বা ইউনিয়ন পরিষদের কাছেও প্রতিষ্ঠানটির কোনো তথ্য নেই।
রিহ্যাব সদস্য পরিচয়ে প্রতারণা
প্রতিষ্ঠানটি ‘রিহ্যাব’-এর সদস্য রয়েছে এজন্য আবাসন প্রকল্পের জন্য কোন অনুমোদন না নিয়েই শত শত গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সাবেক দুই কর্মকর্তা জানান, মেগা টাউন ও মেগা শান্তিনিকেতন প্রকল্প থেকে যে টাকার বিক্রি হয়েছে, তার বড় অংশ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুরাদ ইকবাল চৌধুরী তার ব্যক্তিগত খরচে ব্যবহার করেছেন। তারা বলেন,
এখন যদি কোম্পানির অডিট করা হয়, দেখা যাবে শতকরা ৮০ ভাগ টাকাই এমডি আত্মসাৎ করেছেন। ছেলেকে আমেরিকায় পাঠানোর খরচ এবং ব্যক্তিগত মামলার নিষ্পত্তি—সবই করা হয়েছে গ্রাহকদের টাকায়। প্রকৃতপক্ষে কোনো জমি কেনা হয়নি, শুধুই বনানীর অফিস আর চকচকে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা চালানো হচ্ছে।
এমডির বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ
মেগা বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুরাদ ইকবাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জালিয়াতি, কিস্তিতে গাড়ি ক্রয় করে কিস্তি পরিশোধ না করে পালিয়ে বিদেশ যাওয়া, খুন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে। অভিযোগ রয়েছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত কোটি কোটি টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন।
প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহ আরিফ বিন হাবিব বলেন,
আমি কেবল চাকরি করি। এই বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।অন্যদিকে, এমডি মুরাদ ইকবাল চৌধুরী প্রথমে ফোন রিসিভ করলেও কোনো মন্তব্য না করে কল কেটে দেন। পরবর্তীতে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। সংবাদ প্রকাশের আগ পর্যন্ত তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
বিশ্লেষকদের মতে, রিয়েল এস্টেট খাতে এমন প্রতারণা শুধুমাত্র গ্রাহক নয়, বরং পুরো অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। সাধারণ মানুষের জীবনের সঞ্চয় যদি এমনভাবে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যায়, তবে আবাসন খাতের ওপর জনগণের আস্থা একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।
আইনি উদ্যোগ ও আহ্বান
ভুক্তভোগীরা ইতোমধ্যে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা চান, প্রশাসন এই প্রতারণার জাল ভেদ করে প্রকৃত সত্য বের করে আনুক এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করুক।