রবিবার, ২৭শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে কাঁদছে মানুষ!

মোহাম্মদ ইউনুছ অভি টেকনাফ কক্সবাজার প্রতিনিধিঃ

পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে কাঁদছে মানুষ!

পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে কাঁদছে মানুষ!

পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে কাঁদছে মানুষ!

সেন্টমার্টিন যেন ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। তবে এবার জেগে উঠছে প্রকৃতির ডাকে পর্যটকশূন্য দ্বীপে সৈকতের বালুচরে ফিরেছে সামুদ্রিক জোঁক, ঝিনুক-শামুকের সারি, দেখা মিলছে লাল কাঁকড়ার দল। আকাশজুড়ে উড়ছে মুক্ত পাখি, সমুদ্রের পানিও হয়ে উঠেছে নীল-স্বচ্ছ। প্রকৃতি তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু দ্বীপবাসীর হৃদয়ে বইছে এক অজানা ঝড়। কারণ, প্রকৃতির হাসির আড়ালে চাপা পড়ে আছে মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে কাঁদছে মানুষ!

দ্বীপের শত শত পরিবার আজ জীবিকার অনিশ্চয়তায় দিশেহারা। রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ, হোটেলের দরজা তালাবদ্ধ, ট্যুর গাইডরা এখন বেকার। সেইসব মানুষ, যারা বছরের পর বছর পর্যটকদের আতিথেয়তায় জীবন চালিয়েছেন, এখন পকেটে এক টাকাও নেই, অথচ সংসার চলে চারদিকে দাবি নিয়ে।

গত সপ্তাহে ভোর ৬টায় দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে হাঁটছিলেন স্থানীয় জেলে আব্দুর রহিম। কাঁধে জাল, হাতে চায়ের কাপ। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তার চোখের সামনে বিশাল এক লাল কাঁকড়া ধীরে ধীরে বালু খুঁড়ে নিজের গর্তে ঢুকে পড়ছে। রহিম বলেন, “বছর তিনেক আগে এমন দৃশ্য নিয়মিত দেখতাম। এখন আবার দেখা যাচ্ছে। মানুষ কম আসলে প্রকৃতি নিজের জায়গায় ফিরে আসে। এইটাই সত্যি।”

সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটক প্রবেশ বন্ধ। সেই থেকে দ্বীপের চারপাশে নেমেছে এক অপূর্ব নীরবতা। দ্বীপের ইউপি সদস্য সৈয়দ আলম মেম্বার জানান, “প্রতিদিনের ভিড় না থাকায় এখন কেয়াগাছ নিজের মতো করে বেড়ে উঠছে। প্যারাবনে পাখিরা আশ্রয় নিচ্ছে, আর সমুদ্রপাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝিনুক, কাঁকড়া। পরিবেশের উন্নতি চোখে পড়ার মতো।”

বেসরকারি সংস্থা নেকমের সহকারী প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান জানান, “এবারের মৌসুমে মা কাছিমের ডিম পাড়ার হার বেড়েছে। কারণ সৈকতে পর্যটকের চাপ নেই। এটি পরিবেশের জন্য আশার খবর।”

জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ায়, আর প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক না থাকায় সাগরের পানি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ। এমন মন্তব্য করে স্থানীয় যুবক হায়দার আলী বলেন, “আগে সমুদ্রপাড়ে শুধু বোতল, প্যাকেট, চিপসের মোড়ক পড়ে থাকত। এখন সেইসব নেই। পানি এত স্বচ্ছ, যেন আয়নার মতো। শামুক আর ঝিনুক বালুর ওপর সারি করে পড়ে থাকে।”

পরিবেশ অধিদপ্তর ৫ ফেব্রুয়ারি ড্রোনের মাধ্যমে বর্জ্য চিহ্নিত করে, ১২-১৩ ফেব্রুয়ারি দুইদিনে প্রায় ৯৩০ কেজি বর্জ্য অপসারণ করে, যার ৯০ শতাংশই ছিল প্লাস্টিক ও চিপসের প্যাকেট। টেকনাফ ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, “সামান্য নিয়ন্ত্রণেই পরিবেশ কতটা বদলাতে পারে, তা চোখে দেখা যায় সেন্টমার্টিনে। এটি একটি বড় শিক্ষা।”

দ্বীপে যখন প্রকৃতি স্বস্তি পাচ্ছে, তখন মানুষের জীবন ভেঙে পড়ছে। দ্বীপের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সরাসরি পর্যটন নির্ভর। পর্যটন বন্ধ থাকায় রেস্টুরেন্ট, হোটেল, ট্যুর গাইড, বোট সার্ভিস সবই অচল হয়ে গেছে।

মহিউদ্দিন, এক তরুণ গাইড, চোখের কোণে অশ্রু নিয়ে বললেন, “গত বছর দিনে ৫০০-১০০০ টাকা রোজগার হতো। এখন প্রতিদিন ঘুম ভাঙে না খেয়ে। ছোট বোনের স্কুল ফি বাকি, মা ওষুধ কিনতে পারছে না। আমরা যেন ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছি, কেউ টেরও পাচ্ছে না।”

সিঙ্গারা বিক্রেতা মরিয়ম খাতুন বলেন, “রান্না করা খাবারও পড়ে থাকে। লোকজন তো নেই। একদিন বিক্রি না হলে সেদিনের খরচ উঠে না। দুই ছেলেমেয়ের মুখে কী তুলে দেবো, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।”

স্থানীয় এক রেস্টুরেন্ট মালিক বললেন, “দুই মাসে যা আয় করেছি, তাতে কর্মচারীদের বেতনও হয়নি। এখন টেকনাফে গিয়ে নতুন করে শুরু করছি। দ্বীপে থাকতে পারলাম না।”

হোটেল থালা বাসন ধুয়ার কাজ করতেন জাহানারা খাতুন। তিনি বলেন, “আগে দিনে দিনে ১০০০ টাকা পর্যন্ত ইনকাম হতো। এখন বাসায় বসে থাকতে হয়। ছেলে-মেয়েদের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছি।

দ্বীপের প্রবীণ বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন, “প্রকৃতি ভালো আছে, এটা সত্যি। কিন্তু মানুষ খারাপ আছে। শুধু প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে লাভ কী, যদি মানুষ বেঁচে না থাকে?

স্থানীয়দের মতে, অভাবের কারণে দ্বীপের শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। কেউ কেউ বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যাচ্ছে সাগরে, কেউ বা চট্টগ্রাম বা কক্সবাজারে কাজ খুঁজতে পাড়ি দিচ্ছে। দ্বীপে কোনো বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা নেই। সরকারি সাহায্যও খুবই সীমিত।

সচেতন মহল বলছেন, “সেন্টমার্টিনে প্রকৃতির রূপ ফেরার গল্প যতটা সুন্দর, ততটাই করুণ এখানকার মানুষের সংগ্রামের চিত্র। তাই এখন সময় এসেছে দ্বীপবাসীর পাশে দাঁড়ানোর। পরিবেশ রক্ষার নামে যদি জীবিকা ধ্বংস হয়, তাহলে সেটা কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়। দরকার টেকসই পর্যটন নীতি, যেখানে নিয়ন্ত্রিত ভ্রমণ, সুনির্দিষ্ট সীমানা, ও পরিবেশবান্ধব ব্যবসা চালু থাকবে। পাশাপাশি দরকার বিকল্প আয়ের সুযোগ, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিশেষ সরকারি সহায়তা, যাতে প্রকৃতি ও মানুষ- দু’জনেই নিরাপদে থাকতে পারে।”

এই দ্বীপের কোলেই ঘুমিয়ে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে অপরূপ প্রকৃতি। আর এখানেই হাহাকার করছে জীবিকার টানাপড়েনে জর্জরিত মানুষ। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হলে মানুষকেও রক্ষা করতে হবে- এই সত্যকে সামনে না আনলে সমাধান অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। এমনটাই অভিমত সংশ্লষ্টদের

পাঠক প্রিয়,

আপনিও আবাসননিউজ২৪.কম-এ ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি নিয়ে লিখতে পারেন।

আপনার লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ [email protected]