মেরুং ইউনিয়নের চিটাইংগা পাড়ায় বিদ্যুৎ ও পানির সংকট চরমে: উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে শতাধিক মানুষ
খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চিটাইংগা পাড়ার বাসিন্দারা ২০২৫ সালের এই আধুনিক সময়ে এসেও বিদ্যুৎ ও নিরাপদ পানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই এলাকার প্রায় ১২০ জন মানুষের জীবন এখনো নির্ভর করে প্রাচীন কষ্টসাধ্য ব্যবস্থার ওপর।
চিটাইংগা পাড়ার দূরত্ব দীঘিনালা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার, মেরুং থেকে ২ কিলোমিটার এবং মেইন সড়ক থেকে ১ কিলোমিটার। তথ্যসূত্রে এই জনপদে নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান — ৩২ জন করে এবং ছেলে মেয়ে মিলিয়ে মোট জনসংখ্যা প্রায় ১২০ জন।
গত সোমবার, ২১ এপ্রিল চিটাইংগা পাড়ায় সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, নারী-পুরুষ, বিশেষ করে মহিলারা সিরিয়াল ধরে পাহাড়ের নিচে টিউবওয়েলের সামনে অপেক্ষা করে কলসিতে পানি সংগ্রহ করছেন। কলসি মাথায় করে তারা খাড়া পাহাড় বেয়ে পানি বহন করে নিয়ে আসছেন। অনিয়মিত পানি সরবরাহ ও নষ্ট টিউবওয়েলের কারণে এই দুর্ভোগ প্রতিদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি আবাসনের বরাদ্দকৃত গ্রামের একমাত্র টিউবওয়েলটি বহুদিন ধরে নষ্ট অবস্থায় রয়েছে। বাকি যে দুটি চালু টিউবওয়েল আছে, সেগুলোও প্রায়ই অচল হয়ে পড়ে। ফলে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
তাদের এই দূরাবস্থার কথা জানতে চাইলে স্থানীয় গৃহবধূ মোছাঃ শারমিন আক্তার বলেন, “আমাদের এলাকায় পাহাড়ের নিচে মাত্র ২টা টিউবওয়েল, সিরিয়াল ধরে পানি নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে হয় আমাদের। এই কল দুটোও মাঝে মাঝে নষ্ট হয়ে যায়। তখন আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করে আনতে হয়।”
বিদ্যুৎ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত এই এলাকার মানুষ। ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা হারিকেনের আলোয় পড়ালেখা করতে বাধ্য। কখনও তেল শেষ হয়ে গেলে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম শ্রেণির ছাত্র রাকিব জানায়, “আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নাই। হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে হয়। হারিকেনের তেল শেষ হয়ে গেলে আর পড়া যায় না।”
বয়স্ক বাসিন্দা জজ মিয়া বলেন, “আমরা বহুদিন ধরেই এই গ্রামে বসবাস করছি, কিন্তু এখনও বিদ্যুৎ ও পানির কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা হয়নি। নলকূপগুলো পাহাড়ের নিচে হওয়ায় বিষেষ করে মহিলাদের পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। বিদ্যুৎ না থাকা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ দূরে হওয়ায় ছেলেমেয়েরাও পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে।”
চিটাইংগা পাড়ার ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যাপারে স্থানীয়রা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে ১৭ জন, গণশিক্ষায় যুক্ত ১৮ জন এবং হাইস্কুলে ৭ জন শিক্ষার্থী। তবে ৬-৭ জন অন্য কাজের সাথে যুৃ্ক্ত রয়েছে, কোনো শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত নয়। এলাকার সবচেয়ে কাছের প্রাথমিক স্কুল ২ কিলোমিটার এবং হাইস্কুল ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, যার পথ পাহাড়ি ও কষ্টসাধ্য।
পাঁচ আগষ্টের পর থেকে মেরুং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং ৬ নং ওয়ার্ডের পুরুষ সদস্য না থাকায় ৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা মহিলা ইউপি সদস্য জমিলা হোসেন (লিলি) এর কাছে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে চিটাইংগা পাড়ার এই দূরবস্থার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “চিটাইংগা পাড়া একটি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যা চলছে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় গভীর নলকূপ স্থাপন করা যাচ্ছে না, ফলে পানির সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময় কিছু এনজিও বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যার বিষয়ে জরিপ করে গিয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে আর কেউ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দূরত্ব ও পাহাড়ি উচু নিচু রাস্তার কারণে ছেলেমেয়েরা খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করছে। আমরা বারবার এ সকল বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, তবুও এখনও পর্যন্ত স্থায়ী কোনো সমাধান হয়নি। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান জরুরি, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের কষ্ট লাঘবের জন্য।”
এই সব সংকটের মাঝে এলাকাবাসী দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন, যেন দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্যুৎ ও পানির স্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয়দের মতে, সময়মতো এই সমস্যা সমাধান না হলে শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও জীবনমানও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে