শনিবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

রিয়েল এস্টেটে প্রতারণার মহোৎসব: সাইনবোর্ডেই কোটি টাকার ফাঁদ, গ্রাহকদের দাবি মনিটরিং সেল গঠন

বিশেষ প্রতিবেদকঃ

রিয়েল এস্টেটে প্রতারণার মহোৎসব

বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট খাত এখন যেন এক ‘অদৃশ্য প্রতারণার কারখানা’। জমি নেই, বৈধ অনুমোদন নেই, কোনো স্থায়ী ঠিকানাও নেই—তবুও ঝাঁ-চকচকে বিজ্ঞাপন, চটকদার প্রস্তাব আর সাজানো অফিস দিয়ে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে কিছু অসাধু রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছু প্রতিষ্ঠান এখন সাইনবোর্ডভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনা করছে, যার পেছনে নেই কোনো বাস্তব ভিত্তি।

রিয়েল এস্টেটে প্রতারণার মহোৎসব

ভুয়া অফিস, বড় সাইনবোর্ড, লোভনীয় অফার
প্রতারণার ধরন এখন আরও আধুনিক এবং পরিকল্পিত। অনেক কোম্পানি বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় একটি ছোট অফিস ভাড়া নেয়, সামনে ঝলমলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। তারপর শুরু হয় বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপন—ফেসবুক, ইউটিউব, পত্রিকা, বিলবোর্ড, রাস্তায় ব্যানার—সব জায়গায় “সাশ্রয়ী দামে প্লট বা ফ্ল্যাট” অফার।

এই সব কোম্পানি এমন সব জায়গায় প্রকল্প দেখায় যা বাস্তবে হয়তো সরকারি জমি, খাসজমি বা এখনও কেনাই হয়নি। গ্রাহকদের “আজ বুক করলে কালই ডিসকাউন্ট”, “মাত্র ১০% ডাউন পেমেন্টে প্লট”, “ইন্সট্যান্ট রেজিস্ট্রেশন”—এই ধরনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আকৃষ্ট করে। শুরুতে কিছু ডকুমেন্ট দেখিয়ে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করে, কিন্তু পরে টাকার পর টাকা নিয়েও কোনো রেজিস্ট্রেশন বা জমি হস্তান্তর করে না।

গ্রাহকরা বলছেন—এ যেন এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতারণা
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই প্রতারণা যেন রীতিমতো সংগঠিত একটি অপরাধচক্রের মতো। চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার এক গ্রাহক বলেন, “আমি ২০২১ সালে ঢাকার একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করি। তারা বলেছিল ৬ মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন হবে। আজ তিন বছর কেটে গেছে, অফিসে গেলে কেউ ফোন তোলে না, অফিসও এখন আর খোলা নেই।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক মার্কেটিং অফিসার বলেন, “অনেক কোম্পানি আমাদের বলত শুধু বুকিং আনো। জমি নাই, রেজিস্ট্রেশন হবে না, এটা আমরা জানতাম। চাকরির জন্য করতে হতো। যেদিন গ্রাহক বুঝে যেত প্রতারণা হচ্ছে, তার পরদিনই অফিস বন্ধ করে দিত কোম্পানি।”

কর্মচারীদেরও করুণ পরিণতি
এই প্রতারক কোম্পানিগুলো তাদের নিজস্ব কর্মচারীদের প্রতিও চরম অমানবিক আচরণ করছে। নিয়োগ দেয় ছাঁটাইয়ের ভয়ে, দেয় না বেতন, মাসের পর মাস মিথ্যা আশ্বাসে আটকে রাখে। কেউ প্রতিবাদ করলে চাকরি থেকে বাদ, আবার কেউ কেউ তো কোম্পানির পক্ষে গ্রাহকের টাকা নিয়েই উধাও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—নিয়ন্ত্রণহীন এই খাত ধ্বংস ডেকে আনছে
অর্থনীতি ও আবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে যদি রিয়েল এস্টেট খাত চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে এই খাত থেকে কেউ আর আস্থা নিয়ে বিনিয়োগ করবে না। সরকারকে এখনই কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রতিটি কোম্পানির লাইসেন্স, প্রকল্প ও আর্থিক অবস্থা যাচাই করতে হবে।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (REHAB)-এর সদস্যপদ রয়েছে এমন কিছু কোম্পানি এবং সদস্যপদ না থাকা কোম্পানিগুলোর ওপর বিশেষ নজরদারি, ভুয়া প্রকল্প বন্ধ, এবং প্রতারণার দায়ে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির নজরদারিতে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করা অতিব জরুরীরে হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি মনে করছেন গ্রাহক এবং বিশেষজ্ঞরা।
রিয়েল এস্টেট খাত মানুষের জীবনের সঞ্চয়ের জায়গা—একটি বাড়ির স্বপ্ন নিয়েই তারা ফ্ল্যাট বা প্লট কেনে। এই স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যমের সম্মিলিত ভূমিকা ছাড়া এই প্রতারণা থামানো সম্ভব নয়। মানুষ যেন প্রতারিত না হয়, সে জন্য জরুরি নিয়ন্ত্রণ, সচেতনতা এবং বিচার।
এমন অবস্থায় সরকারের কাছে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে নজরদারির জন্য একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠনের দাবি উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেমনটি দেশের ইন্স্যুরেন্স খাত একসময় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, তখনই রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি রেগুলেটরি সংস্থা— বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) গঠন করে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। ফলস্বরূপ, ইন্স্যুরেন্স খাতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে আসে।
ঠিক তেমনি, বর্তমানে রিয়েল এস্টেট খাতে প্রতারণা, দুর্নীতি ও অনিয়ম ঠেকাতে এখনই একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠন করা সময়ের দাবি। এটি না হলে, এই খাতটি একসময় পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রস্তাবিত এই মনিটরিং সেল রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর প্রকল্প অনুমোদন, অর্থ লেনদেন, গ্রাহকদের সঙ্গে চুক্তি, নির্ধারিত সময়ে হস্তান্তর এবং গ্রাহক অভিযোগ নিষ্পত্তির বিষয়গুলো তদারকি করবে। এতে এই খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে বলে মত বিশ্লেষকদের।

একটি ক্রেতা অধিকার সংগঠনের মুখপাত্র জানান, “আমরা প্রতিনিয়ত রিয়েল এস্টেট সংক্রান্ত জটিলতা ও প্রতারণার অভিযোগ পাচ্ছি। অনেকেই বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও ফ্ল্যাট পান না, আবার কেউ কেউ ঠকেন টাকা দিয়েও জমি না পেয়ে। তাই সরকারের উচিত এখনই এই খাতটি সুশৃঙ্খল করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, যেমনটা ইন্স্যুরেন্স খাতের ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছিল।”
প্রসঙ্গত, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছে শত শত রিয়েল এস্টেট কোম্পানি। তবে, এদের অনেকেই নেই সঠিক অনুমোদন, আর্থিক সক্ষমতা বা পর্যাপ্ত সম্পদ। ফলে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ এবং বিনিয়োগকারীরা।

আরও পড়ুনঃ আজ এবং আগামীকাল থেকে সারা দুনিয়া বাংলাদেশকে চিনবে

পাঠক প্রিয়,

আপনিও আবাসননিউজ২৪.কম-এ ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি নিয়ে লিখতে পারেন।

আপনার লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ abasonnewsfeature@gmail.com