রবিবার, ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

‘আমি মারা গেলে তুমি শহীদের গর্বিত মা হবে’ : বলেছিল রেজাউল

অনলাইন ডেস্ক

‘আমি মারা গেলে তুমি শহীদের গর্বিত মা হবে’- ছাত্রবিরোধী বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিতে নিষেধ করলে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ কথাই বলেছিল মো. রেজাউল করিম।

মাত্র ১৬ বছর বয়সী রেজাউল ছিল মীরহাজারীবাগ আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ৪ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা সংলগ্ন এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সে। ওইদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে রেজাউলও ছাত্রআন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার চেয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা পরে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে রূপ নেয়। রেজাউলের মৃত্যুর ঠিক পরদিন, ৫ আগস্ট প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসন চালানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

সম্প্রতি যাত্রাবাড়ীর মীরহাজারীবাগ এলাকার নিজ বাসায় এই প্রতিবেদক রেজাউলের শহীদ হওয়া নিয়ে কথা বলতে গেলে শোকে পাথর রেজাউলের মা রাশিদা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমাদের তিন সন্তানের মধ্যে রেজাউল ছিল একমাত্র ছেলে। এই কষ্ট কীভাবে সইব?’

বড় মেয়ে ফাতেমাতুজ জোহরা (১৮) দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে, আর ছোট মেয়ে তানজিলা (১০) তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

জুলাই মাসজুড়ে রাস্তায় গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছিল। তখন রাশিদা ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতেন। কিন্তু রেজাউলের দৃঢ়চেতা মনোভাব আর সংগ্রামের প্রতি অঙ্গীকরের কারণে তাকে থামানো যায়নি।।রাশিদা বলেন, ‘একদিন যখন আমি ওকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলাম,

‘সে বলেছিল, যদি আন্দোলনে যাই, কী হবে? যদি গুলিতে মারা যাই, আমি শহীদ হব, তুমি শহীদের মা হবে।’ এখন এই কথাগুলোই আমার মাথার ভেতর বাজে।’ তিনি আরও জানান, রেজাউল পড়াশোনায় মনোযোগী ছিল, ভালো ছেলে ছিল।

রেজাউলের বাবা মো. আল আমিন মির (৪৮), একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তিনি জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই রেজাউল অংশ নিচ্ছিল।

তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট বিকেলে কুতুবখালীতে বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যায় রেজাউল। সেখানে বিকেল ৫টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় সে। কিন্তু আমি সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে জানতে পারি।’

মির বলেন, একজন ফোন করে জানান যে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গিয়ে ছেলের খোঁজ নিতে হবে। হাসপাতালে গিয়ে তিনি ৭ নম্বর কক্ষে ছেলেকে নিথর অবস্থায় স্ট্রেচারে পড়ে থাকতে দেখেন।

তিনি বলেন, ‘ভর্তি করানোর পরও কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। পরে জরুরি বিভাগ থেকেই কোনো ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া লাশ নিয়ে বাসায় ফিরি।’

দাফনের সময় নানা প্রতিবন্ধকতা ও প্রশাসনিক উদাসীনতা ছিল বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, স্থানীয় কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান হাবুর কাছে গিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট চাইলে তিনি দিতে রাজি হননি।

কাউন্সিলর তাদের হয়রানি না করার আশ্বাস দিলেও পরদিন (৫ আগস্ট) কবরস্থানে লাশ দাফন করতে গেলে সেখাকোর লোকজন তদন্ত দল না আসা পর্যন্ত দাফন করা যাবে না বলে জানায়।

অসহায় হয়ে মির শ্যামপুর থানায় গিয়ে তদন্ত দল পাঠানোর অনুরোধ করেন, কিন্তু ওসি তা নাকচ করে দেন।

মির বলেন, ‘আমি ওসিকে বলি, আমি আমার ছেলের হত্যার ঘটনায় মামলা করতে চাই, কিন্তু উনি মামলা নিতে রাজি হননি। উনি বলেন, স্থানীয় কাউন্সিলরের অফিস থেকে সার্টিফিকেট এনে দাফন শেষ করতে।’

পরে তারা আবার কাউন্সিলরের অফিসে যান এবং একটি সাধারণ ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে জুরাইন কবরস্থানে ছেলেকে চিরনিদ্রায় শায়িত করেন।

ভাঙা কণ্ঠে মির বলেন, ‘আমরা এখন বিধ্বস্ত। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আমি কোনো কাজে মন দিতে পারছি না। ওর মা প্রতিরাতে কাঁদে।’

রেজাউলের বন্ধু মো. রাকিব তাকে সাহসী ও নিষ্ঠাবান বন্ধু হিসেবে স্মরণ করেন। একই পাড়ায় ভিন্ন স্কুলে পড়লেও তাদের বন্ধুত্ব ছিল গভীর। রাকিব বলেন, ‘রেজাউল ছিল আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন।’

ঘটনার দিন বিকেলে রাকিব ও রেজাউল একসঙ্গে টোল প্লাজার কাছে স্লোগান দিচ্ছিল। ঠিক তখনই পেছন থেকে গুলিবিদ্ধ হয় রেজাউল।

রাকিব বলেন, ‘গুলির পর রেজাউল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, রক্তে ভেসে যায় চারপাশ।’ আন্দোলনকারী অন্যদের সহায়তায় তাঁরা দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে করে রেজাউলকে ঢামেকে নিয়ে যান। সেদিন রাকিব নিজেও একটি রাবার বুলেটে আহত হন।

রেজাউলের মৃত্যু পরিবার ও বন্ধুদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। তাঁর পরিবার খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি- মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে।

সূত্র-বাসস

পাঠক প্রিয়,

আপনিও আবাসননিউজ২৪.কম-এ ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি নিয়ে লিখতে পারেন।

আপনার লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ abasonnewsfeature@gmail.com