সোমবার, ১৬ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

চার চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের অর্থনীতি

নতুন অর্থবছরে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হবে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা, ডলার সংকট মোকাবিলা করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো। দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এসব খাতে লক্ষ্য অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিং।

সদ্য বিদায়ি অর্থবছরেও খাতগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এমনকি অর্থবছরের মাঝপথে অর্থাৎ গত জানুয়ারিতে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েও তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, এসবের পাশাপাশি আরও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আইএমএফ-এর শর্তের বাস্তবায়ন এবং এর প্রভাব মোকাবিলা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে আস্থার সঞ্চার করা, রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক অবস্থায় আনা। এছাড়া টাকা পাচার রোধ এবং হুন্ডির প্রভাব কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। এত লম্বা সময় মূল্যস্ফীতি মাত্রাতিরিক্ত হারে থাকায় অর্থনীতিতে বড় ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। যার দায় বেশির ভাগই পড়ছে স্বল্প ও মধ্য-আয়ের ভোক্তার ওপর। বিভিন্ন সময় এ হার কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও তা অর্জিত হয়নি। উলটো বেড়েই চলেছে। গত বছরের মার্চে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে ওঠে। এরপর থেকে গত মে পর্যন্ত এ হার সামান্য ওঠানামা করে ৯ শতাংশের ওপরেই অবস্থান করেছে। কখনো ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি চলে গেছে। মেতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে। চলতি অর্থবছরে এ হার সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে ছাপানো টাকায় সরকারকে ঋণের জোগানও বন্ধ করেছে। পাশাপাশি ছাপানো টাকায় গঠিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন তহবিলের আকারও ছোট করা হচ্ছে। একই সঙ্গে উৎপাদন খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে।

আরও পড়ুন  ফেলানী খাতুন থেকে স্বর্ণা দাস: সীমান্ত হত্যার শেষ কোথায়

দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। এ কারণে আমদানি যেমন সংকুচিত করা হয়েছে, তেমনই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও কমেছে। পাশাপাশি ডলারের দাম বেড়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ৩২ থেকে ৫৩ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। দুই বছর ধরেই আমদানি কমেছে গড়ে ১৮ শতাংশ করে। ২০২২ সালের আগস্টে এক মাসে সর্বোচ্চ ৯৫০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। এখন তা কমে প্রতিমাসে গড়ে খোলা হচ্ছে ৪৭০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার এলসি। এভাবে ডলারের ওপর চাপ কমানো হচ্ছে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। রপ্তানি আয় মে পর্যন্ত বেড়েছে ২ শতাংশ। গত মে মাসে এ খাতে আয় কমেছে ১৬ শতাংশ। তবে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়তে শুরু করেছে। আগামী দিনে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে রপ্তানি আয়ে।

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। চলতি বছরে ৩ শতাংশের কম বাড়বে রেমিট্যান্স। গত বছর ৩ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে। গত মে থেকে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে ডলারের দাম একদিনে ৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করতে হবে। তখন এর দাম আরও বেড়ে গিয়ে টাকার মান কমিয়ে দেবে। আইএমএফ-এর মতে, বাংলাদেশের টাকা অতিমূল্যায়িত। এর মান আরও কমাতে হবে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগের চ্যালেঞ্জগুলো তো রয়েই গেছে। মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, বিনিয়োগ বাড়ানো ও রাজস্ব আয় বাড়ানো। এগুলোর পাশাপাশি এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে ২০২৬ সাল থেকে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে। সেগুলোও এখন থেকে মোকাবিলা করতে হবে। অর্থ পাচার, হুন্ডি, খেলাপি ঋণ- এগুলোও চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। এ অর্থবছরেও সরকারকে খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে। বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। নজর রাখতে হবে সুদের হার যাতে বেশি না বাড়ে। ডলারের প্রবাহ বাড়িয়ে টাকার মানকে স্থিতিশীল রাখাটা জরুরি।

আরও পড়ুন  সরকারি চাকরি অধ্যাদেশে অপপ্রয়োগের সুযোগ আছে দেখবে সরকার: জ্বালানি উপদেষ্টা

চলতি মাসের শেষদিকে আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফ-এর শর্তে এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানোর নীতি গ্রহণ করা হবে। ফলে ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে। ব্যাংকে তারল্যের প্রবাহও কমবে। ফলে ঋণের খরচ বেড়ে যাবে।

একদিকে ডলারের দাম, ঋণের সুদ, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসায় খরচ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় বাড়ছে না। উলটো মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার কারণে আরও কমে যাচ্ছে। এতে ভোক্তার ভোগের সক্ষমতা কমেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা যেমন কমছে, তেমনই ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের কারণে জোগানও কমেছে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও কমেছে। ফলে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। বেকারদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মসংস্থান হচ্ছে না।

এদিকে চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এর মধ্যে শিল্প খাতে ডলারের জোগান, কম সুদে ঋণ বিতরণ এবং অন্যান্য নীতিসহায়তা দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মুদ্রানীতিতে বেশকিছু পদক্ষেপ থাকছে। তবে তা কতটুকু অর্জন করা সম্ভব, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ, বিদায়ি অর্থবছরের মুদ্রানীতির বেশির ভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।

অর্থনৈতিক মন্দা, বিনিয়োগ হ্রাস, ডলার সংকট ও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও কম। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণও কম হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। এতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে বিনিয়োগও। রাজস্ব আয় না বাড়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট থাকায় চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে ঋণের জোগানও দিতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায়ও ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারের আর্থিক সংকট প্রকট হচ্ছে। এ সংকট কাটাতে সরকার বিভিন্ন সেবার মূল্য ও ফি বাড়াচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপরও চাপ বাড়ছে।

আরও পড়ুন  আ.লীগের ভেতরের গোপন পরিকল্পনা ফাঁস: রাজনৈতিক অস্থিরতায় টার্গেট ছিল বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি নেতারা

গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহে বাধা, দেশীয় মুদ্রার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশ এর সুবিধা পাচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বমুখী সমন্বয় এবং বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির এসব উপকরণের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে রয়েছে শুধু টাকার মান স্থিতিশীল রাখার বিষয়টি। বাকিগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে এককভাবে মূল্যস্ফীতির হার কমানো সম্ভব নয়। এজন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

আইএমএফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এখন বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হচ্ছে। অর্থনীতিকে করোনা মহামারির আগের অবস্থায় নিতে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে।

WhatsApp
Facebook
Twitter
LinkedIn
Email
Telegram