রাজনৈতিক চাপে লোকসানি ট্রেনে জর্জরিত রেলওয়ে সমীক্ষা ছাড়াই কোটি কোটি টাকার ব্যয়

বাংলাদেশে নতুন আন্তনগর ট্রেন চালুর পেছনে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক চাপ এবং ব্যক্তিগত আগ্রহ দীর্ঘদিন ধরেই রেলওয়ের জন্য বিরাট বোঝায় পরিণত হয়েছে। প্রকৃত যাত্রীচাহিদা যাচাই না করেই একের পর এক ট্রেন চালু হওয়ায় এখন বেশিরভাগ রুটেই লোকসান গুনছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কিছু ট্রেনে যাত্রী এতটাই কম যে, খরচের সামান্য অংশও উঠে আসছে না।
এমনই এক উদাহরণ ‘বিজয় এক্সপ্রেস’। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে চালু হয়ে পরবর্তীতে জামালপুরে স্থানান্তরিত হওয়া এই ট্রেনটিতে এখন যাত্রী নেই বললেই চলে। রেলওয়ে কর্মকর্তাদের অভিযোগ, স্থানীয় নেতাদের দাবিতেই অর্থনৈতিক সমীক্ষা ছাড়াই এই রুটে ট্রেনটি চালু রাখা হয়েছে।
সরকারি শাসনামলে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের চাপে একের পর এক নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন তার নিজ জেলা পঞ্চগড়ের জন্য একাধিক নতুন আন্তনগর ট্রেন চালু করেন এবং একটি স্টেশনের নামকরণ করেন পরিবারের সদস্যের নামে। সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, ঢালারচর এক্সপ্রেসসহ বেশ কয়েকটি ট্রেনেও একই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ আছে।
যেমন সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস চালুর পেছনে সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের চাপই মুখ্য ছিল। তবে সিরাজগঞ্জে ট্রেন রাখার স্থান না থাকায় প্রতিদিন ঈশ্বরদী থেকে নিয়ে আসা হয়, ফলে জ্বালানি ও সময় অপচয় হয়। তবুও মাসিক আয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না।
এদিকে ঢাকা-নোয়াখালী রুটের উপকূল এক্সপ্রেসেও যাত্রীর সংখ্যা কমছে। বাস সার্ভিস ও সড়ক যোগাযোগের উন্নতির ফলে ট্রেনের প্রতি আগ্রহ কমছে যাত্রীদের। এর মধ্যেও ২০২৩ সালে নতুন আরেকটি ট্রেন ‘সুবর্ণচর এক্সপ্রেস’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়, যদিও কোচ সংকটে তা থমকে আছে।
উত্তরাঞ্চলে বিপরীত চিত্র — কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস, লালমনিরহাট এক্সপ্রেস বা একতা এক্সপ্রেসের মতো ট্রেনগুলো গড়ে শতকরা ১১৪ ভাগ আসন পূরণ করে এবং কোটি টাকার বেশি আয় আনে। কিন্তু পর্যাপ্ত কোচ বা বিকল্প রেকের অভাবে সেবা ব্যাহত হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অলাভজনক ট্রেন বন্ধ করে লাভজনক রুটে ট্রেন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এ নিয়ে অতিরিক্ত সচিব রূপম আনোয়ারের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে, তবে এখনো কার্যকর কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।
বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক মনে করেন, ‘সমীক্ষা ছাড়া নতুন ট্রেন চালু করা বা নতুন স্টেশনে থামানো এক ধরনের অপেশাদারিত্ব। রেল কখনোই লাভের জন্য চলে না — এ কথার আড়ালে যে অপচয় হয়, তার বোঝা পড়ে রাষ্ট্রের ঘাড়ে।’