নর্থ সাউথ গ্রুপের হাইকোর্ট, রাজউক ও জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য: পেইড প্রতিবাদে বৈধতা আসে না, প্রকল্প বিক্রি চলছে অবৈধভাবে

নর্থ সাউথ গ্রুপের লোগো ও পেইড বিজ্ঞাপনচিত্র, যেখানে অর্থের বিনিময়ে ‘প্রতিবাদ’ ছাপিয়ে নিজেদের বৈধতা প্রমাণের অপচেষ্টা চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নর্থ সাউথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি,নিরাপদ ভ্যালি,নর্থ সাউথ গ্রীন সিটি নামে বিতর্কিত আবাসন প্রকল্প পরিচালনা করছে নর্থ সাউথ গ্রুপ। অথচ এসব প্রকল্পের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রয়েছে হাইকোর্টের রায়, রাজউকের নিষেধাজ্ঞা এবং গাজীপুর জেলা প্রশাসনের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা। সব নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কতা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি গোপনে প্লট বিক্রির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে গত ১৫ জুন, দেশের জনপ্রিয় আবাসনভিত্তিক অনুসন্ধানী নিউজ পোর্টাল ‘আবাসন নিউজ ২৪’–এ “নর্থ সাউথ গ্রুপের জালিয়াতি ফাঁস: হাইকোর্টের রায়, প্রকল্প বন্ধ, বিপাকে গ্রাহকরা” শিরোনামে একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ওই প্রতিবেদনে প্রকল্পের অবৈধ কার্যক্রম, প্রশাসনিক অভিযান, আদালতের আদেশ এবং ভুক্তভোগী গ্রাহকদের বক্তব্যসহ বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনের প্রভাবে নর্থ সাউথ গ্রুপের বিরুদ্ধে জনমতের চাপ বাড়তে থাকে। কিন্তু আজ ২৬ জুন ২০২৫, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমানের স্বাক্ষরিত একটি পেইড ‘প্রতিবাদ’ বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। এতে প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই—এমন বার্তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজউকের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে নিরাপদ ভ্যালি প্রকল্পটি অবৈধ ঘোষণা করে কার্যক্রম বন্ধে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একইভাবে হাইকোর্ট নর্থ সাউথ ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি প্রকল্প বাতিল করে দেয়। তা সত্ত্বেও নর্থ সাউথ গ্রুপ উল্লিখিত প্রকল্পে গোপনে প্লট বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
গাজীপুর সদর উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা একাধিকবার এলাকা পরিদর্শন করেছি। মাইকিং, ব্যানার টানানোসহ সাধারণ জনগণকে সতর্ক করেছি। এরপরও যদি তারা কার্যক্রম চালাতে থাকে, তাহলে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গাজীপুর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ মঈন খান এলিস আবাসন নিউজ ২৪’-কে বলেন, ঐতিহ্যবাহী বেলাই বিলে কোনো ধরনের আবাসন প্রকল্প বা ভরাট কার্যক্রম অনুমোদনযোগ্য নয়। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে নর্থ সাউথ গ্রুপের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করেছি এবং গড়ে ওঠা স্থাপনা ভেঙে দিয়েছি। এই বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ ও রাজস্ব বিভাগ পুরো বিষয়টি সম্পর্কে অবগত রয়েছে। আমাদের নির্দেশনায় প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি তারা গোপনে কার্যক্রম চালায় বা প্লট বিক্রি করে, তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এই পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রে ‘প্রতিবাদ’ নামে পেইড বিজ্ঞাপন প্রকাশ করাকে ‘সাংবাদিকতা নয়, বরং জনমত প্রভাবের ব্যর্থ অপপ্রয়াস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন অভিজ্ঞ সংবাদকর্মীরা।

দৈনিক যুগান্তরের একজন দায়িত্বশীল সিনিয়র রিপোর্টার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই ধরনের ‘প্রতিবাদ’ আসলে অর্থের বিনিময়ে প্রকাশিত একটি বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন। এটি কোনো প্রকৃত সাংবাদিকতাপ্রসূত প্রতিবেদন নয়। পত্রিকার নির্ধারিত হারে প্রতি ইঞ্চি বা প্রতি কলাম হিসেবে টাকা দিয়ে যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিতে পারে। কিন্তু এতে প্রকৃত সংবাদ বা তদন্তমূলক রিপোর্টের সত্যতা অস্বীকার করা যায় না।
এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ড. মো. শাহীনুর রহমান বলেন, সংবাদ মুছে দিয়ে ও টাকার বিনিময়ে প্রতিবাদ বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা জাতির জন্য বিপজ্জনক বার্তা। সত্য প্রকাশে যদি বাধা দেওয়া হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়ে যায়।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আদালতের রায় অমান্য করে প্রকল্প পরিচালনা করা গুরুতর অবজ্ঞাসূচক অপরাধ। প্রশাসনের উচিত এমন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কোনো গণমাধ্যম যদি টাকা নিয়ে সত্য প্রতিবেদন সরিয়ে ফেলে এবং বিপরীতে মিথ্যাচার প্রচার করে, তা হলে সেটি আর গণমাধ্যম থাকে না, সেটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
এদিকে বহুবার চেষ্টা করেও নর্থ সাউথ গ্রুপের সিইও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মাহফুজুর রহমানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোন ও ই-মেইলে যোগাযোগ করেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এই বিষয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, যারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, তাদের কাছ থেকে আমরা আরও বেশি সততা ও দায়িত্বশীলতা আশা করি। কোনো সাবেক সামরিক কর্মকর্তা যদি পরিচয় ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করেন, তাহলে তার জবাবদিহি আরও বেশি কঠিন হওয়া উচিত।
এদিকে প্রকল্পটির গ্রাহক ও জমি ক্রেতারা চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। রফিকুল ইসলাম নামে এক প্রবাসী বলেন, জীবনের শেষ সঞ্চয় দিয়ে প্লট কিনেছিলাম। এখন জানি সব কিছুই ভুয়া।প্রকল্প বাতিল, কেউ কোনো উত্তর দেয় না। বিধবা নারী শামীমা আক্তার বলেন, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জমি কিনেছিলাম। এখন বুঝি আমরা শুধু প্রতারণার শিকার। সরকার যেন আমাদের পাশে দাঁড়ায়।
নর্থ সাউথ গ্রুপ বর্তমানে বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে তাদের প্রকল্পের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাইকোর্ট, রাজউক এবং জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকা প্রকল্পে বিনিয়োগ করা আইনগত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই জমি বা ফ্ল্যাট কেনার আগে যথাযথ যাচাই-বাছাই করতে হবে।
এদিকে নর্থ সাউথ গ্রুপের বর্তমান উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান খান-এর বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে একটি এক্সক্লুসিভ অনুসন্ধান প্রতিবেদন শিগগিরই আবাসন নিউজ ২৪-এ প্রকাশিত হবে।
হাইকোর্টের আদেশ, রাজউকের নোটিশ এবং জেলা প্রশাসনের বারবার অভিযান সত্ত্বেও যদি কেউ অবৈধভাবে প্রকল্প চালিয়ে যায় এবং প্রতারণা অব্যাহত রাখে, তাহলে সেটা শুধু আবাসন খাত নয়, পুরো সমাজ ব্যবস্থার জন্যই হুমকি। তাই রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের দায়িত্ব এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।