রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরের আবাসন ও নির্মাণ খাত এখন এক নজিরবিহীন সংকটকাল অতিক্রম করছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিনিয়োগ ও ক্রয়চাহিদায় বড় ধস নামায় একের পর এক প্রকল্প থমকে গেছে, বন্ধ হচ্ছে বুকিং, আর নতুন প্রকল্প নিতে পারছেন না অধিকাংশ ডেভেলপার। ফ্ল্যাট বিক্রি অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় অনেকে বাধ্য হচ্ছেন নির্মাণ ব্যয়ের নিচে ইউনিট বিক্রি করতে। ফলে দেখা দিয়েছে ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা, আর সরাসরি ও পরোক্ষভাবে যুক্ত প্রায় ২ কোটি মানুষের জীবিকায় পড়েছে চাপ।
বিক্রির হার কমেছে ৩০-৫০ শতাংশ
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পরিচালক আইয়ুব আলী আবাসন নিউজ২৪-কে জানান, ‘‘গত কয়েক মাসে ফ্ল্যাট বিক্রি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে এসেছে। বড় কোম্পানিগুলো কোনওরকমে টিকে থাকলেও মাঝারি ও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী বেতন, অফিস ভাড়া ও ব্যাংক কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে নির্মাণ ব্যয়ের নিচে গিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রি করছেন শুধু ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে।’’
ক্রিডেন্স হাউজিং-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিল্লুল করিম বলেন ,‘‘বিক্রিতে পতনের হার আমাদের প্রতিষ্ঠানে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। এর পাশাপাশি “ড্যাপ” বাস্তবায়ন আমাদের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। জমির অনুমোদন, ভবন নকশা—সবকিছুই দুরূহ হয়ে পড়েছে।’’
বিলাসবহুল ইউনিটে চাহিদার বড় পতন
বিটিআই-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান বলেন, ‘‘উচ্চমূল্যের ইউনিটগুলোতে চাহিদা মারাত্মকভাবে কমেছে। মাঝারি দামের ফ্ল্যাট কিছুটা চললেও সেটাও নিরাপত্তাহীনতার কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’’
ড্যাপ বাস্তবায়নের প্রভাব: উচ্চতা-ঘনত্ব সীমাবদ্ধতায় নতুন প্রকল্প থেমে গেছে
২০২২-২০৩৫ মেয়াদের ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নের পর থেকেই আবাসন প্রকল্প গ্রহণে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। পূর্বে ১০তলা পর্যন্ত অনুমোদন মিলত যে এলাকায়, সেখানে এখন অনুমোদন মিলছে মাত্র ৫ থেকে ৬ তলার। এতে জমির মালিকেরা আর ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘‘ড্যাপ বাস্তবায়নে উচ্চতা সীমা এতটাই রেসট্রিকটিভ হয়েছে যে জমির ব্যবহারযোগ্যতা কমে গেছে। আমরা ২০০৮ সালের মতো ফ্লোর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছি, যাতে বাজারে গতি আসে।’’
নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে, বিক্রি কমে যাচ্ছে
গত এক বছরে নির্মাণ সামগ্রীর দাম ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। রড, সিমেন্ট, ইট, লিফট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, টাইলসসহ আবাসন-নির্ভর ২০০টিরও বেশি শিল্প আজ ধসের মুখে। রডের চাহিদা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
রিহ্যাবের মতে, এই খাতে সরাসরি যুক্ত ৪০ লাখ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ২ কোটি মানুষ। সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে পুরো অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
কালোটাকা বিনিয়োগে কর বাড়লেও সুযোগ থাকছে
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখলেও করহার অনেক বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন:
গুলশান/বনানী এলাকায় ২০০ বর্গমিটার ফ্ল্যাটে প্রতি বর্গফুটে কর হবে ২,০০০ টাকা (বাড়তি ২৫৯%)
ছোট ফ্ল্যাটে কর ৩৮৪% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে
এনবিআর বলছে, এটি সুযোগ নয়, বরং ‘‘কর পরিশোধের বিনিময়ে আইনি নিরাপত্তা’’
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার মূলত রাজস্ব আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করছে এবং একইসঙ্গে আবাসন খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ দিচ্ছে।
ফ্ল্যাট বিক্রির নিম্নগামী প্রবণতা: ২০২৩-২৫
২০২৩: মাথাপিছু আয় বাড়লেও বাজার স্থবির
২০২৪: সামান্য উন্নতি, কিন্তু গতি ফেরেনি
২০২৫: রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রম অসন্তোষ, বৈদেশিক চাপ—সব মিলিয়ে ভয়াবহ মন্দা
নিবন্ধন কর কমানোর স্বস্তি
২০২৫-২৬ বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনে উৎসে কর হ্রাস করা হয়েছে:
ঢাকা-চট্টগ্রাম: ৮% → ৬%
অন্যান্য সিটি: ৬% → ৪%
পৌরসভা-ইউনিয়ন: ৪% → ৩%
ফ্ল্যাট কেনাবেচায় খরচ কমে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি মিলবে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের।
আবাসন খাতের এই সংকট আর একা একটি খাতের সংকট নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে চরম ঝুঁকি। সময়মতো বাস্তবভিত্তিক ও সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন, আয় এবং কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে।
অবিলম্বে জরুরি নীতিগত হস্তক্ষেপ, ড্যাপ সংশোধন ও বাস্তবমুখী করনীতি ছাড়া এই খাতের বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব নয়।