স্বপ্নের নামে প্রতারণা: ‘গ্রিন ভ্যালি’ ও ‘স্বপ্ন ভ্যালি’ প্রকল্পে নকশিকলা প্রোপার্টিজ লিঃ ভয়াবহ জালিয়াতি, নারী কর্মীদের অভিযোগে চাঞ্চল্য

একটা সময় বাংলাদেশে জমি বা ফ্ল্যাট মানেই ছিল নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু এখন এক শ্রেণির প্রতারক ‘আবাসন’ শব্দটিকেই করে তুলেছে ভয় আর সন্দেহের নাম। নারায়ণগঞ্জের দাউদপুর এলাকায় এমনই এক ভয়াবহ প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে নকশিকলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে, যারা ‘গ্রিন ভ্যালি’ ও ‘স্বপ্ন ভ্যালি’ নামে দুইটি প্রকল্পে জমি বিক্রি করছে কোনো বৈধ অনুমোদন ছাড়াই।
চটকদার বিজ্ঞাপন, কিন্তু নেই কাগজপত্র!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ফেসবুকে লাইভ, পোস্টার, বিলবোর্ডের মাধ্যমে আকর্ষণীয় অফার দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে স্থানীয়দের দাবি—
“এই জমিগুলোর মালিক তারা নয়। শুধু সাইনবোর্ড লাগিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে জমি বিক্রি করছে।”
চেয়ারম্যান বললেনঃ কোনো অনুমোদন নেই
এ বিষয়ে দাউদপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন— “আমি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার সময়ে কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ‘গ্রিন ভ্যালি’ এবং ‘স্বপ্ন ভ্যালি’ প্রকল্পের কোনো অনুমোদন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া হয়নি।”
ছবিঃচটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে আবাসন মেলা নামে প্রতারণা
সচিবের বক্তব্যঃসরাসরি প্রতারণা
ইউনিয়ন সচিব শামীম মিয়াও বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন—এই কোম্পানি আমাদের কাছ থেকে কোনো অনাপত্তি পত্র (NOC) নেয়নি। তাদের প্রকল্পগুলো পুরোপুরি অবৈধ।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর অনৈতিক প্রস্তাব ও বেতন বঞ্চনার অভিযোগ
নকশিকলা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের প্রতারণা শুধু জমি নিয়েই নয়, বিস্তৃত হয়েছে তাদের অফিস সংস্কৃতিতেও। সংস্থার বর্তমান ও সাবেক বেশ কয়েকজন বিক্রয় প্রতিনিধি—নারী ও পুরুষ উভয়েই—আবাসন নিউজ ২৪-কে জানিয়েছেন, কোম্পানিতে নিয়মিত বেতন দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস কাজ করেও অনেকে পাননি প্রাপ্য সম্মানী।
তাদের ভাষায়—এমডি স্যার শুধু তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নারী প্রতিনিধিকে ঠিকমতো বেতন দেন। বাকি সবার ব্যাপারে কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
আরও গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন দুজন সাবেক নারী কর্মী। তাদের দাবি—কাজের সুযোগ দেওয়ার নামে এমডি স্যার আমাদের অনৈতিক প্রস্তাব দেন। আমরা তা প্রত্যাখ্যান করলে তিনি আমাদের চাকরি থেকে সরিয়ে দেন।
এইসব অভিযোগের বক্তব্যের প্রমাণস্বরূপ কিছু কল রেকর্ড ও মেসেজ আবাসন নিউজ ২৪-এর কাছে জমা দিয়েছেন তারা।
তবে বিষয়টি নিয়ে নকশিকলা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হুদা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নুরুল হুদার অতীত: বারবার একই প্রতারণার ছক
এইসব অভিযোগের পেছনে যে একটা ধারাবাহিক পরিকল্পনা রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে নুরুল হুদার অতীত ঘেঁটে। অনুসন্ধানে জানা গেছে—
নুরুল হুদা পূর্বে আরও তিন থেকে চারটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রতিবারই একই কৌশলে জমির কাগজ না থাকা সত্ত্বেও বিক্রির চেষ্টা এবং নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
প্রতারিত একজন গ্রাহক বলেন—
এই লোকটা জানে, কিভাবে ফেসবুকে পোস্ট আর কথার জাদুতে সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে টাকা তুলে নেওয়া যায়।”
তার মত কিছু মানুষের কারণে পুরো রিয়েল এস্টেট খাত আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
নকশিকলা প্রোপার্টিজ লিমিটেডের মতো কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র নিজেদের লাভের জন্য পুরো আবাসন শিল্পের বদনাম ডেকে আনছে।”
প্রমাণ শুনেই ফোন কেটে দেন এমডি!
এই অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হুদা প্রথমে বলেন—আমার কাছে সব বৈধ কাগজ আছে
কিন্তু যখন তাঁর সামনে চেয়ারম্যান, সচিব ও নারী কর্মীদের বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়, তিনি ফোন কেটে দেন এবং এরপর আর ফোন রিসিভ করেননি।
এটা শুধু প্রতারণা নয়—মানুষের জীবনের সঙ্গে নির্মম খেলা
জমি মানে শুধু একটি টুকরো মাটি নয়। এটা একজন মানুষ ও তার পরিবারের স্বপ্ন, শ্রম, সঞ্চয়, এবং ভবিষ্যৎ। এই স্বপ্নের সঙ্গেই প্রতারণা করছে নকশিকলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড। এটা আইনি অপরাধের বাইরেও এক গভীর মানবিক ট্রাজেডি।
সাধারণ মানুষের প্রশ্ন: কতদিন এভাবে চলবে?
প্রমাণ থাকার পরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো নীরব। প্রশাসনের এই নিষ্ক্রিয়তা ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে।
এটা শুধু একটি কোম্পানির দুর্নীতি নয়—এটা একটি খাতের মর্যাদাকে পদদলিত করার ঘটনা। আমরা চাই, প্রশাসন এখনই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক এবং সাধারণ মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুক।