বুধবার, ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শ্যামনগরে জীবনযুদ্ধে জয়ী স্বীকৃতি প্রাপ্ত পাঁচ অদম্য নারী

রনজিৎ বর্মন শ্যামনগর(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধি :

ছবিঃ সংগৃহীত

উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাে প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রামে লড়াই করে চলেছেন এমন অসংখ্যা নারী রয়েছেন। এর মধ্যে লড়াই করে অনেকেই সাফল্যের চুড়াই পৌঁছে গেছেন আবার অনেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সবার অলক্ষে কাজ করে সমাজ বির্নিমানে তারা প্রতিনিয়ত ভুমিকা রেখে চলেছেন। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতিক হিসাবে অনেকে জয়িতা হিসাবে সম্মাননা পেয়েছেন। সারা দেশের ন্যায় শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক বেগম রোকেয়া দিবসে প্রতিবছর পাঁচটি ক্যাটাগরিতে পাঁচজন তৃণমূলের নারীকে জয়িতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে জীবনযুদ্ধে জয়ী সর্বশেষ জয়িতা সম্মাননাপ্রাপ্ত উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার পাঁচ ক্যাটাগরির পাঁচ নারীর সফলতার চিত্র।

সফল জননী অনিমা হালদার

সফল জননী হিসাবে জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর গ্রামের অনিমা হালদার। পিতা মাতা পরিপূর্ণ বয়সে তাকে নকিপুর গ্রামের পূর্ণ চন্দ্র হালদারের সাথে বিবাহ দেন। শ্যামনগর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। বিবাহের পর পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে থাকেন এ অবস্থায় ৪টি সন্তানের জননী হিসাবে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। সন্তানদের লেখাপড়া চলাকালিন সময়ে স্বামী পূর্ণ চন্দ্র হালদার দুরারোগ্যব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ১৯৯৮ সালে মারা যান। এর পর শুরু হয় সন্তানদের নিয়ে জীবনযুদ্ধ। চরম আর্থিক সংকটের মাঝে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবেন। স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য জমিতে ফসল ফলিয়ে ও গরু পালন করে জিবীকা নির্বাহ শুরু করেন ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যান। কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হতে পেরেছেন। বর্তমানে বড় মেয়ে এম এস এস শেষ করে শ্যামনগর উপজেলার ৭৫ নং নকিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। বড় ছেলে বুয়েট থেকে এম এস সি শেষ করে প্রিন্সিপাল অফিসার (বি আই এফ এফ এল) এর অধীনে, ছোট ছেলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে এম এস এস শেষ করে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ(টেকনিক্যাল মার্কেট ডেভলপমেন্ট সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড) হিসাবে এবং ছোট মেয়ে খুলনা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এম এস সি শেষ করে ইমপেরিয়াল কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং খুলনা এর অধীনে কর্মরত রয়েছেন। তিনি তার সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে সফল জননী মনে করেন। বর্তমানে সফল জননী হিসাবে এলাকায় তার সকলে সম্মান প্রদর্শন করেন। জয়িতা পুরস্কার প্রাপ্তি হওয়ায় তিনি নিজেকে ধন্য মনে করেন।

নির্যাতনের বিভিষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানো নারী মারুফা খাতুন

দুঃখ কষ্টের ভিতর থেকে বেড়ে ওঠা এক নারী মারুফা খাতুন। শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ী গ্রামের পিতা ইশার আলী ও মাতা জবেদা খাতুনের কন্যা তিনি। মনের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতে যেয়ে বলেন নিজের জীবন কাহিনী থেকে কিছুটা প্রকাশ করে কিছুটা হালকা হতে পারছি। তিনি বলেন জীবনের কাহিনী বর্ণনা করতে যেয়ে ভিতর থেকে সাড়া দেয় দুঃখ কষ্টের। মারুফা খাতুন ভারাক্রান্ত মনে বলেন ছোট বেলায় শিশু শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার পিতা দুই বোন ও এক ভাই সহ তার মাকে সারা জীবনের জন্য ছেড়ে দিয়ে আর একজনকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। এ অবস্থায় সকলের ঠাঁই হল এক প্রকার গাছ তলায়। নিজেদের আতœীয় পরিজনও কেহ এ সময়ে পাশে ছিলনা। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে। তার মায়ের ছোট ছোট তিনটা সন্তান থাকায় কাজের সুযোগ ছিল কম। শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে চাইলেও মালিক পক্ষ রাজি হত না। এভাবে চলতে চলতে একটি কাজ যোগাড় হয় তার মায়ের বেসরকারি সংস্থায়। এখান থেকে খাবারের চাহিদা কিছুটা মিললেও বাসস্থান ও বস্ত্রের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়নি। মায়ের ভাত তারা সকলে ভাগ করে খেতেন। এই সংস্থার কাজে যাওয়া আসার পথে পরিচয় হয় এক সরকারি কর্মকর্তার সাথে। এই কর্মকর্তা তার মায়ের জীবন কাহিনী শুনে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেন কলবাড়ী সরকারিভাবে নির্মিত আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরে। এই ঘরে থেকে তারা বড় হতে থাকেন এবং তার মা মাত্র ৪০০ টাকা মজুরী পান। সময়টা ছিল ২০০১ সাল। ভাই বোনদের মধ্যে সে বড় থাকায় মা কাজে গেলে সব ভাইবোনদের তাকে দেখা শুনা করতে হত। আবার কোন কোন সময় মায়ের কাজে সহায়তা করতে হত। এরই মাঝে নিজে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন মারুফা খাতুন। বাসস্থানের সাথে হাঁস, মুরগী পালন করে লেখাপড়ার খরচ চালানোর ব্যবস্থা করেন। লেখাপড়ায় ৫ম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে তার লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণির উপবৃত্তির টাকা ও বাড়ীর ছাগল পালনের টাকা দিয়ে সংসারের খরচ, লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে দিন যাপন করতে থাকেন। পড়তে পড়তে প্রায় প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম হওয়ায় তার লেখাপড়ার আগ্রহ বেড়ে যায় এবং ২০১৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে। এরপর শ্যামনগর সরকারি মহসীন ডিগ্রী কলেজে বাংলা বিষয়ে অনার্স ভর্তি হয়ে পড়তে পড়তে একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হন এবং পরিবারের হাল ধরেন। ছোট বোন বেশি লেখাপড়া করতে না পারায় বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কিন্ত গায়ের রং কালো হওয়ায় পাত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন তার মা সিদ্ধান্ত নেয় বড় মেয়ে মারুফাকে বিয়ে দিবে এবং ২০১৮ সালে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর কিছুদিন ভাল কাটতে কাটতেই গায়ের রং কালো হওয়ায় শ^শুর বাড়ী থেকে ২ লক্ষ টাকা আনার চাপ দেওয়া হয়। মায়ের দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় শুরু হয় শারিরীক মানষিক নির্যাতন। বন্দি করে রাখা হত ঘরে। কারো সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে দিতনা । চরিত্রহীন সহ নানা কটু ভাষায় গালিগালাজ করত তার স্বামী ও শ^শুরবাড়ীর লোকজন। এভাবে চলতে চলতে তার গর্ভে আসে কন্যা সন্তান। কন্যা সন্তান বিধায় সন্তান নষ্ট করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে তার উপর। এক পর্যায়ে তাকে বাইরে কাজে যাবে বলে মায়ের কাছে রেখে পাঠিয়ে দেয় এবং কিছুদিন পরে ডিভোর্স পত্র পাঠিয়ে দেয়। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় র‌্যাব-৬ ক্যাম্পে জানানো হলে আলোচনান্তে দেনমোহর বাড়িয়ে দিয়ে আবারও স্বামীর বাড়ী পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীর বাড়ী যাওয়ার পর আবারও শুরু হয় নির্যাতন। রাতে নেশা করে এসে স্বামী নির্যাতন করত প্রায়ই এবং লেখাপড়া করতে দেখলে উপহাস করত শ^শুর বাড়ীর লোকজন। কিন্ত সব কিছু উপেক্ষা করে অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা দিই ও ফাস্ট ক্লাস পাই এবং এর পরই তার কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। বাপের বাড়ী থেকে সন্তান জন্মের পর স্বামী তার বাড়ীতে নিয়ে যায় কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার নির্যাতন শুরু করে। একদিন তাকে মেরেই ফেলবে এমনভাবে মারধোর করে,পরবর্তীতে তার ভাই খবর পেয়ে তাকে নিয়ে চলে আসে। এরপর সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় আর স্বামীর কাছে ফিরে যাবেনা। আবার লেখাপড়া শুরু করে এর মাঝে একটি এনজিওর চাকুরী পেয়ে যান। চাকুরী করে এম এ পাশ করেছেন। এখন তার গ্রামের অনেকে সন্ধান করে পরামর্শ নেওয়ার জন্য বিশেষ করে নারীরা। নারীদের নিয়ে একটি সমবায় সমিতি তৈরী করে তার নিবন্ধনও পেয়েছেন। এই সমিতির মাধ্যমে নারীদের বিভিন্ন আয় সৃষ্টি মুলক প্রকল্প গ্রহণ করে নিজে ও নারীদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মত প্রকাশ করেন সমাজের অবহেলিত নারীদের জন্য কাজ করার।

আরও পড়ুন  শ্যামনগরে পুলিশের অভিযানে পরিত্যক্ত পুকুর থেকে ৩৪ পিচ হাসুয়া উদ্ধার

শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী আছমা খাতুন

দুই ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে সকলের ছোট আছমা খাতুন। বড় ভাই বোনেরা স্কুলে যেত সেটা দেখে তারও খুব ইচ্ছা হত স্কুলে যেতে সেকারণে তার পিতা মাতা চার বছর বয়সে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আছমা খাতুনের জন্মস্থান সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার দত্তনগর গ্রামে। পিতা ছকিমউদ্দীন গাজী ও মাতা জয়গুন বিবি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর শ্যামনগর উপজেলার নুরনগর আশালতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তখন ভাই একজন খুলনা বিএল কলেজে লেখাপড়া করত। পিতার আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকার জন্য নবম শ্রেণিতে পড়াকালিন সময়ে তার বিবাহ হয় এবং বিবাহের পরও স্বামীর অর্থাভাবে অসুস্থতা জনিত কারণে সুচিকিৎসার অভাবে মারা যান। কিছুদিন থাকার পর তার ভাই আছমা খাতুনকে পিতার বাড়ীতে নিয়ে আসেন এবং আবার লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করে খুলনার একটি কলেজে এইচ এস সি ভর্তি হয়ে সেখানেও বিজ্ঞান বিভাগে পাশ করে ভাল রেজাল্ট নিয়ে। খুলনায় লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর তাই শ্যামনগর মহসীন ডিগ্রী কলেজে বি এ ভর্তি হয়ে পাশ করে। এর পর পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি দেখে প্রাইমারী স্কুলে আবেদন করেন এবং চাকুরী পেয়ে যান। চাকুরী কালিন তার আবার বিয়ে হয় ২০০০ সালে এবং ২০০৩ সালে একটি কন্যা সন্তান ও ২০০৫ সালে একটি পুত্র সন্তানের জন্মদেন। বর্তমানে ছেলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ও কন্যা সন্তান বিএল কলেজে লেখাপড়া করছেন। তিনি শ্যামনগর উপজেলার মধ্য কৈখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন। আছমা খাতুন বলেন ইচ্ছা শক্তি ও পরিশ্রমের দ্বারা তার এই সফলতা।

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী আমিরুননেছা

সাহসী মনোবল আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি নারীকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। তেমনই এক কঠোর পরিশ্রমী নারী আমিরননেছা। নিজের ইচ্ছাশক্তি কে কাজে লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রম আর নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জন করে রীতিমত তাক লাগিয়েছেন পুরো এলাকা জুড়ে। সাতক্ষীরার উপকুলীয় শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের পার্শ্বে খালি গ্রামের শাহিন ইসলামের স্ত্রী আমিরননেছা।

আরও পড়ুন  প্রথমবারের মতো সুপেয় পানির দাবিতে ব্যতিক্রমধর্মী এক ম্যারাথন

বিয়ের পরে হতদরিদ্র স্বামীর পরিবারের সংসারের হাল ধরতে হয় আমিরননেছাকে। স্বামীর একার আয়ে সংসারের সকল খরচ সংকুলান হয়না। যে কারণে শ্বশুর বাড়ি আসার পর থেকে শুরু হয় আমিরুনের দৈনন্দিন মজুরি দেওয়া সহ বাইরের নানাবিধ কাজ। কখনো ঘেরের লোনা পানিতে সারাদিন কাজ করা, কখনো পুরুষ মানুষের সাথে পুকুরের মাটির কাজ করা, কখনো ঘেরের শামুক বেছে দেওয়া। এভাবে বিভিন্ন ধরনের দৈনন্দিন মজুরির কাজ করে সংসারের স্বামীর আয়ের সাথে পারিবারিক আয় বাড়াতে থাকেন তিনি।
পরপর দুইটি পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ায় তাদের ৪ জনের সংসারের খরচ যোগানো খুব কস্ট হয়ে যাচ্ছিলো দুজনের। স্বামী সুন্দরবনের মাছ কাঁকড়া আহরণ করে আয় বাড়ালেও তাতে সংকুলান হচ্ছিলনা এবং প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অসুখের সম্মুখিন হতে হয় তাদের। আমিরননেছা মনে মনে কোন ছোট খাটো কাজ খুঁজছিলেন। কোন এক সময় তিনি দর্জির কাজ শিখেছিলেন কিন্তু সেলাই মেশিন ও অন্যান্য উপকরণের অভাবে কাজ করার সুযোগ হয়নি। ২০২১ সালের একটি বেসরকারী সংগঠনের সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি আয়বর্ধন কর্মকান্ড হিসেবে একটি সেলাই মেশিন ও কিছু বিভিন্ন রকমের সিট কাপড়ের সহায়তা পান। এর পর স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে আমিরননেছা কাজ শুরু করেন।

বাড়ীর আশে পাশের প্রতিবেশী ও পরিচিত জনদের সাথে নিজের দর্জি কাজের কথা বলতে থাকেন এবং দিনদিন তার পরিচিতি বাড়তে থাকে। নিজের এলাকার প্রতিবেশিদের ছোটখাট অর্ডার আসতে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। এখন আর দিন মজুরী দেওয়া লাগেনা। আমিরননেছা এ বিষয়ে বলেন, “স্বামীর একার আয়ে বর্তমান সময়েটিকে থাকা কষ্টকর, তাই সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য সেলাই মেশিন এর কাজ ও সিট কাপড়ের ব্যবসা করে আয় করছি। এনজিওর প্রয়োজনীয় মালামাল সহযোগিতা নিয়ে ব্যবসাটাকে ভালো ভাবে চালু করতে পারছি। লাভের টাকা দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে নিয়মিত সঞ্চয় জমা করি।”সপ্তাহ বা ১৫ দিন পর পর সীট কাপড় বিক্রির টাকা একত্রিত করে পুনরায় মালামাল কিনে এনে ব্যবসাকে সমৃদ্ধি করে চলেছেন তিনি।

এলাকার অধিকাংশ নারী ও শিশুদের পোশাক তৈরির জন্য প্রচুর পরিমানে অর্ডার আসে প্রতিদিন। যে কারণে তিনি একার পক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করতে পারেননা। সে কারণে তার সেলাই কাজে সহযোগিতা করার জন্য আলাদাভাবে দুই জন কর্মী নিযুক্ত করেছেন। আমিরননেছার কাজের বিস্তৃতির আরো একটি মূল কারণ হল তার কাছে নানা ধরনের সীট কাপড় রয়েছে। বাজারের দামেই সীট কাপড় পাওয়া যায় সেজন্য লোকজন তার কাছ থেকে সীট কাপড় ক্রয় করেন। তাছাড়া তার হাতের কাজের কোয়ালিটি খুব ভালো এবং নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক তৈরী করতে পারায় সর্বদা কাজের ভিড় লেগে থাকে।

আরও পড়ুন  শ্যামনগরে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর জীবন মানোন্নয়নে বকনা গরু বিতরণ

নিজের বাড়ীতেই সীট কাপড় এর দোকান ও সেলাই মেশিন এর কাজ করে সম্মৃতি পেয়েছেন আমিরননেছা। তিনি এলাকার আরো ৩/৪ জন নারীকে কাজের সুযোগ করতে পেরেছেন। এলকার ২/৩ তিন জন নারী প্রতিদিন এখানে এসে কাজ করেন। প্রতি মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করতে পারছেন বলে তিনি জানান। লাভের টাকা দিয়ে তিনি একটি ব্যাটারী চালিত ভ্যান কিনেছেন। বর্তমানে তার দোকানে প্রায় ২৫ হাজার টাকার সীট কাপড় রয়েছে। তিনি এখন স্বপ্ন দেখছেন ছোট ছেলেকে লেখাপড়া শিখানোর পাশাপাশি তার স্বামীকে একটি ইঞ্জিন চালিত ভ্যান কিনে দেবেন। পরে নিজের দোকান ও বসত ঘর টাকে পাকা করবেন।

আর্থিকভাবে সাবলম্বী আমিরননেছা এলাকার একজন উদ্যোগী নারী হিসেবে সুপরিচিত। তার সফলতার গল্প নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবে। যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে।

সমাজ উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছেন যমুনা রানী

নিজ প্রতিভা, আত্মশক্তি ও মেধাবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে সমাজ উন্নয়নের জন্য কাজ করতে পারা মানুষেরা স্থাপন করেন অনন্য দৃষ্টান্ত। এমনই একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী উপকুলীয় নারীযোদ্ধা যমুনা রানী। বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরার উপকুলীয় শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের যমুনা রানী সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখায় ইতিমধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছেন। স্বামী ও এক সন্তান সহ তিন সদস্যের ছোট্ট সংসার তার। স্বামী মনিন্দ্র সরদার (৩৬) পেশায় দিনমজুর। ছেলে সুজন (১০) ৫ম শ্রেণীতে পড়া লেখা করে। এলাকায় সমাজের নানা অসঙ্গতি বা সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সেখানেই দেখা মেলে যমুনার।

দরিদ্র ঘরের বধু হয়েও তেমন কোন আয়েশি জীবন জীবিকা প্রত্যাশা নেই তার। পারিবারিক ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা যে অবহেলিত ও পিছিয়ে আছেন তা যমুনা রানী বয়স ও বুদ্ধির সাথে সাথে অনুধাবন করতে থাকেন। তিনি মনে করেন পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সবক্ষেত্রে সম মর্যাদার দাবীদার। তিনি সমাজে নারীর অবস্থা ও অবস্থান সুদৃঢ় করার মনোভাব ও ইচ্ছা পোষণ করেন। একজন সক্রিয় নেত্রী হিসেবে তিনি সমাজের উন্নয়ন কর্মকান্ডে তিনি নিজেকে সপে দেন। কোথাও ছোট রাস্তা সংস্কার, কোথাও বনায়ন সৃষ্টি, কোথাও পারিবারিক কলহ, কোথাও সামাজিক উৎসব এলাকার এ সকল কর্মকান্ডে সবার আগে দেখা মেলে সুপরিচিত যমুনার মুখ। মুখ ভরা হাসি নিয়ে হাজির যে কোন সমস্যা সমাধানে। নিজ এলাকার প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সকল মানুষের জন্য সরকারী বেসরকারী সেবা আদায়ে স্থানীয় সরকার ও সুশীল সমাজের মানুষের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করে দৃষ্টান্ত তৈরী করেছেন সদা হাস্যোজ¦ল নারী যমুনা। তার স্বামীও অনেক খুশি স্ত্রীর এই ধরনের অন্যের কল্যান মূলক কাজ করার জন্য।

নারীনেত্রী হিসেবে তিনি সমাজের উন্নয়নে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ নিরোধ, যৌতুক, মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতন, প্রবীন অধিকার, কৃষি ও পুষ্টি নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন ধরনের উঠানবৈঠক ও আলোচনার নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় তার।

২০২১ সালে একটি বেসরকারী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। ২০ জন নারী সদস্য নিয়ে পথ চলা দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সক্রিয় দায়িত্ব পালন করেন। ২টি ছাগল ও ৬টি দেশী মুরগী সহযোগিতা পান। বুড়িগোয়ালিনী আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করা যমুনা রানী সরকারীভাবে পাওয়া মাত্র ৫ শতক জায়গাতে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষাবাদ ও ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে তার বাড়ীটিকে একটি মডেল কৃষি খামার গড়ে তুলে অনান্য দৃষ্টান্ত তৈরী করেছেন।

একদিকে সমৃদ্ধশীল ও বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কৃষি খামার গড়ে তুলে সফলতা অর্জন করেছেন অপরদিকে মানবিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে একজন সমাজ সেবিকা হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছেন।

এলাকার নারী নেত্রী তথা অভিজ্ঞদের মতে এই সম্মাননা তাদেরতে সামনের দিনে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।

WhatsApp
Facebook
Twitter
LinkedIn
Email
Telegram