‘ছুটি গ্রুপ’ নামক আবাসন চক্রের ভয়াবহ প্রতারণা!

চটকদার বিজ্ঞাপন, লোভনীয় অফার আর কথিত ‘হালাল মুনাফা’র প্রলোভনে সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে ‘ছুটি গ্রুপ’ নামের একটি আবাসন ও রিসোর্ট ব্যবসার নামে প্রতারক সিন্ডিকেট। সাফ কবলা দলিল, আজীবন মালিকানা, ফ্রি রিসোর্ট যাপন, শেয়ার হস্তান্তরের সুযোগ ইত্যাদি শ্লোগানে আকৃষ্ট করে এ চক্রটি দেশের শত শত গ্রাহকের কাছ থেকে কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এক রুম, বহু মালিকঃ বাস্তবতায় ভয়াবহ প্রতারণা
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ‘ছুটি রিসোর্ট কক্সবাজার’ নামে একটি মেগা প্রকল্পের আওতায় শেয়ারপ্রতি ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে মালিকানা বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একজন শেয়ারধারী একটি নির্দিষ্ট ইউনিটের মালিক হবেন এবং আজীবন নির্ধারিত সময়ে তা ব্যবহার করতে পারবেন।কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, একটি রুম বা ইউনিট বহুজনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে—যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও প্রতারণামূলক। কোনো সুনির্দিষ্ট মালিকানা নেই, নেই আইনি স্বীকৃতি। প্রকল্পটি ২০২৭ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা বলা হলেও এখনো ৩ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি। অথচ ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি কয়েকশ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে বসেছে।এখানে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে ফাঁদটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা হলো—রিসোর্টের শেয়ার কেনার পর সঙ্গে সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার কোনো আইনগত সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশে এই ধরনের স্থাপনা নির্মাণ ও রিসোর্ট তৈরি না হওয়া পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন অনুমোদনের নিয়ম নেই। এই আইনগত ফাঁককে হাতিয়ার করেই ছুটি গ্রুপ হাজার হাজার গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করে চলেছে। আর ও অভিযোগ রয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রিহ্যাব সদস্য না হয়েও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে রিহ্যাব মেলায় একটি স্টল নেয় ছুটি গ্রুপ। এতে সাধারণ গ্রাহকদের কাছে তারা রিহ্যাবের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করে। অথচ বাস্তবে তারা রিহ্যাবের সদস্যই নয়। এই চাতুর্যের মাধ্যমে গ্রাহকদের বিশ্বাসভঙ্গ করাই ছিল মূল লক্ষ্য—যা সরাসরি প্রতারণার শামিল।
ভিতরের ভয়ঙ্কর সত্য: সাবেক কর্মীদের জবানবন্দি
আবাসন নিউজ২৪–এর হাতে এসেছে ছুটি গ্রুপের কিছু বর্তমান ও সাবেক বিক্রয় প্রতিনিধিদের লিখিত বক্তব্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রতিনিধি জানান,
সেলস মিটিংয়ে স্পষ্ট বলা হয়—বিক্রি করো, কমিশন নাও। শেয়ার গ্রাহক পাবে কি না, সেটা আমাদের দেখার বিষয় না।আমাদের জানার প্রয়োজন নেই, একটি রুম কতবার বিক্রি হচ্ছে।
এক নারী বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন,
আমাকে বলা হয়, এত কাগজপত্র ক্লায়েন্টকে দেখানোর দরকার নেই। বরং তাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে, কনভেন্স করতে। কারণ আমি ‘মেয়ে মানুষ’, এই সুযোগটা কাজে লাগাতে বলা হতো—হাসিমুখে কথা বললেই হবে। যেন আমার হাসি, ব্যবহার আর শরীরী উপস্থিতিই নাকি ‘প্রেজেন্টেশন’। কিন্তু আমি তাতে রাজি না হওয়ায় চাকরি হারাই। সেই মাসের বেতনও এখনো পাইনি। কয়েকবার কল করলেও কেউ রিসিভ করে না।
ছবিঃ চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য কম্পিউটার দিয়ে তৈরি
আইনি জটিলতা ও জমির অনিশ্চয়তাঃ
‘ছুটি রিসোর্ট কক্সবাজার‘ নামে যে রিসোর্ট নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটি কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ এলাকায় অবস্থিত একটি বিতর্কিত জমিতে। জমিটির মালিকানা নিয়ে মামলা বিচারাধীন, যার এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। জমির মালিকানাই নিশ্চিত নয়—তবুও প্রতিষ্ঠানটি সেই জমিতে ‘রিসোর্ট নির্মাণ’ নাম করে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে চলছে।
একইভাবে গাজীপুরের পূবাইলে ‘ছুটি অরণ্যবাস রিসোর্ট’ নামের আরেকটি প্রকল্পে তেমন কোনো জমি কেনা হয়নি ৫ শতাংশ জমি কিনেছে, অথচ শেয়ার বিক্রি চলছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, তারা জমি বিক্রিতে রাজি নন। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে মৌখিক চুক্তি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে ছুটি গ্রুপ।
‘টাইম শেয়ারিং’-এর নামে বহুগুণ প্রতারণাঃ
টাইম শেয়ারিং’ মডেলে একটি ইউনিট একাধিক ব্যক্তিকে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের সাফ-কবলা দলিল ও আজীবন মালিকানার স্বপ্ন দেখিয়ে বছরের পর বছর লোকসানে ফেলা হচ্ছে। কৌশলে মূল টাকা আটকে রাখা হয় তথাকথিত “মেইনটেন্যান্স ফি” ও “ভবিষ্যৎ উন্নয়ন” খাতে।
একই শেয়ার ১৫-২০ জনের কাছে বিক্রি করেও প্রতিষ্ঠানটি তাদের একজন আরেকজনকে না জানিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে প্রতারণা।
চক্রের মাথায় প্রাক্তন রাজউক কর্মকর্তাঃ
ছুটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান এক সময় রাজউকের কর্মকর্তা ছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগে তিনি চাকরিচ্যুত হন। এরপর মোস্তফা কামাল ও মাসুদুর রহমান মাসুদকে নিয়ে ছুটি গ্রুপ গড়ে তোলেন। জানা গেছে, তাদের বিরুদ্ধে মাদক, নারী কেলেঙ্কারি, জালিয়াতিসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে, যেগুলোর তথ্য দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও রয়েছে।
২০১৩ সালে গাজীপুরে প্রথম রিসোর্ট নির্মাণের পর, পূর্বাচলে আরেকটি প্রকল্প দিয়ে বাজারে বিশ্বাস অর্জন করে। এরপর ‘ছুটি হারমোনি’, ‘ছুটি বে’, ‘ছুটি অরণ্যবাস’, ‘সালতানাত টি রিসোর্ট’সহ নানা নামের প্রকল্প চালু করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে আসছে।
হুমকি ও ব্যঙ্গ–প্রতারণা ঢাকতে নতুন কৌশল
এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে ছুটি গ্রুপের এমডি ইঞ্জিনিয়ার মিজানুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বরং ব্যঙ্গ করে বলেন,
এরকম দশটা মিডিয়া আমাদের হয়ে কাজ করে। আপনারা যা খুশি করেন, এতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আমাদের নিজস্ব মিডিয়া আছে।
তার এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট—তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই, বরং প্রচারণা ও দম্ভ দিয়েই আস্থা অর্জন করে মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করা এদের মূল লক্ষ্য।
ভুক্তভোগীদের আকুতি: আইনানুগ ব্যবস্থা চান গ্রাহকরা
প্রতারিত গ্রাহকরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন দ্রুত এই প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় আনা হয়। তাদের বক্তব্য,
এটা কোনো ভুল বিনিয়োগ নয়। এটি ছিল সুপরিকল্পিত প্রতারণা। আমরা আমাদের কষ্টার্জিত অর্থ ফেরত চাই। আমরা এর বিচার চাই।