শনিবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলীতে শহীদ হন শাওন

অনলাইন ডেস্ক

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লবে শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। ফ্যাসিস্টের পতন ও জুলাই বিপ্লবে শ্রমিকরাও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। জুলাই বিপ্লব ক্রমশ ঢাকার আশেপাশে শ্রমিক এলাকাগুলোতেও ছাত্র-জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন মেনে নিতে পারেনি সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকরাও।

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ এর বিপ্লবে শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। ফ্যাসিস্টের পতন ও জুলাই বিপ্লবে শ্রমিকরাও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। জুলাই বিপ্লব ক্রমশ ঢাকার আশেপাশে শ্রমিক এলাকাগুলোতেও ছাত্র-জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন মেনে নিতে পারেনি সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকরাও। নানা মাত্রায়, কায়দায় আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে, সমর্থন জুগিয়েছে শ্রমিকরা। ঢাকার পাশে আশুলিয়া-সাভার, ভেতরে বাড্ডা-মহাখালী-উত্তরা, একপ্রান্তে গাজীপুর, আরেক প্রান্তে নারায়ণগঞ্জ। প্রত্যেকটিই পোশাক শ্রমিক এলাকায় কারখানায় যাওয়া আর বাড়ি ফেরার পথে আশেপাশে আন্দোলনে সতর্ক ও উৎসুক নজর বাড়ে শ্রমিকদের। কখনো সুযোগ পেয়েই যুক্ত হয়েছে মিছিলে।

কখনো ছবি তুলেছে, ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আন্দোলন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বিরাট সাহসী হয়ে উঠে শ্রমিকরা। কারণ তাদের চোখের সামনে শত শত ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনা তারা মেনে নিতে পারেনি, তাই তারাও ছাত্রদের পাশে দাঁড়ায়, স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ কাঁপায়। তেমনি একজন শ্রমিক ও সাবেক মাদ্রাসা পড়–য়া ছাত্র শাওন (১৯)। ২০ জুলাই ২০২৪ এ পুরো যাত্রাবাড়ি ও শনির আখড়া এলাকার সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছিলো ছাত্র-জনতা-শ্রমিক। কোনভাবেই তাদের আন্দোলন থেকে সরাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ওইদিন বিকেলে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামেন ইউনুছ আলী শাওন। তখনই ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার থেকে র‌্যাবের এলোপাতাড়ি ছোড়া দুটি গুলী শাওনের বুকে বিদ্ধ হয়। শহীদ হন তিনি। স্থানীয়রা জানান, পুলিশের গুলীতে ছেলে হারানোর পর থেকে কেঁদে চলছেন আবুল বাশার। কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না। ছেলের কবরের পাশে বসে কান্না করেন আবুল বাশার।

যেভাবে শহীদ হন শাওন : ২০ জুলাই ২০২৪ দুপুরে প্রতিদিনের মত শাওন দোকান বন্ধ করে খাবার খেতে বাসায় ফিরছিলেন। দোকানের বাইরে আসার পরপরই পুলিশের ছোড়া দুটি গুলী এসে লাগে শাওনের বুকে ও পেটে। বুকের গুলীটি শরীর ভেদ করে বেরিয়ে যায়। শাওন লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এক সময় গুলীবর্ষণ বন্ধ হলে উপস্থিত লোকজন এসে শাওনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালে নেওয়ার আগে শাওন তার পকেটে থাকা মোবাইল দেখিয়ে উদ্ধারকারী একজনকে বলেন আব্বু নামে আমার বাবার মোবাইল নম্বরটি সেভ করা আছে আমার খবরটি বাবাকে জানিয়ে দিন। শাওনের কথামতো তিনি আবুল বাশারকে তার ছেলে গুলীবিদ্ধ হওয়ার খবর জানান। ছেলের মোবাইল থেকে ফোন পেয়ে আবুল বাশারের মনে আনন্দ দেখা দিলেও খবরটি পেয়ে যেন আকাশ ভেঙে তার মাথায় পড়ে। চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। সবাই ছুটে এসে জানতে পারেন শাওন আর এই দুনিয়াতে নেই। খান খান হয়ে যায় আবুল বাশার ও তার স্ত্রী কুলছুম বেগমের লালিত সব স্বপ্ন। বাড়ির সামনেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে কিশোর শাওনকে।

গ্রামবাসী জানায়, এক সময় একটি বসতঘরের অভাবে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আবুল বাশারের পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করতো। পরবর্তীতে গ্রামের লিটনসহ কয়েকজন সহযোগিতা করে আবুল বাশারকে টিনের একটি বসতঘর তৈরি করে দেন।

শাওনের পরিচয় : লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের দক্ষিণ মাগুড়ী গ্রামের কাজী পরিবারের অভাব অনটনের কারণে শহীদ মো. ইউনুছ আলী শাওনের পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। গ্রামের মাদরাসা থেকে ৫ম শ্রেণি পাস করার পর পরই ফুফাতো বোনের জামাইয়ের সাথে চলে যান ঢাকায়। ঢাকার শনির আখড়া এলাকায় বোন জামাইয়ের কসমেটিক দোকানে সেলসম্যানের চাকরি করতো শাওন। গত ৮ বছর ধরে শাওন ভগ্নিপতি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বসিকপুর গ্রামের মোল্যা বাড়ির শাহজাহানের কসমেটিকস দোকানে চাকরি করে আসছেন। শাওনের গুলীবিদ্ধ নিথর দেহ হাসপাতালের ২২টি লাশের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। শাওনের বৃদ্ধ বাবা আবুল বাশার এই তথ্য জানান সাংবাদিকদের।

এ সময় তিনি বলেন, প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর কুলসুম বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। এই সংসারে ইউনুছ আলী শাওন তার একমাত্র সন্তান। প্রথম সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। আগের সংসারের বড় ছেলে ওমর ফারুক (৪০) শ্রমিকের কাজ করে। দ্বিতীয় ছেলে কামরুল হোসেন (৩৫) প্রতিবন্ধী ও মেয়ে শিউলী বেগম(৩০) কে বিয়ে দিয়েছেন।

ইউনুছ আলী শাওন ও প্রতিবন্ধী ছেলে কামরুল হোসেন এবং স্ত্রী কুলসুম বেগমকে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে ওমর ফারুক বিয়ে করে অন্যত্র বসবাস করছেন। অভাব অনটনের সংসারের হাল ধরেছিলেন দ্বিতীয় সংসারের ছেলে ইউনুছ আলী শাওন। মাস শেষে যে বেতন পেতেন তা দিয়ে চলতো তাদের সংসার। শাওন ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পরিবারের সহায় সম্বল বলতে এক চিলতে বসতভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। গ্রামের রাস্তায় সবজি লাগিয়ে এবং অন্যের জমি বর্গা চাষ করে যা পান তাই পরিবারের আয়। শাওনই এই হতদরিদ্র পরিবারের একমাত্র নগদ টাকা আয়ের উৎস ছিল। শাওনের পিতা বলেন, কিভাবে ছেলেকে ভুলব? সারাক্ষণ অনেক স্মৃতি সামনে এসে পড়ে। তাই যখন মনে পড়ে তখনই শাওনের ছবিগুলো দেখি। এর মাধ্যমে খুঁজে পাই তাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে পাখির মতো অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে হত্যা করছে। তাদের প্রত্যেকের বিচার না হলে শাওনসহ অন্য শহীদের আত্মা শান্তি পাবে না। দ্রুত তাদের গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

জামায়াতের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান প্রদান : জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ ও সরকারিভাবে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পাওয়ার কথা জানিয়ে শাওনের পিতা বলেন, এর বাইরে জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আরো কিছু সহযোগিতা পেয়েছি। তিনি বলেন, ছেলেকে হারিয়েছি। কষ্ট থাকলেও দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু অনেক তাজা রক্তের বিনিময়ে। শহীদ ও আহতেরা যেন সম্মান ও যথাযথ মর্যাদা পায় সে দাবি করেন তিনি।