
সকাল ৯টা ৫৫ মিনিট। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে প্রথমবারের মতো সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছাল ‘কপোতাক্ষ’ নামের ইম্প্রুভড মিডিয়াম ফেরি। মুহূর্তেই বদলে গেল দ্বীপের বাতাস।
ঘাটজুড়ে মানুষের ঢল, যেন কোনো উৎসবের মঞ্চ। কেউ হাত নেড়ে, কেউ মোবাইল ফোনে মুহূর্তগুলো ধরে রাখছে, কেউ আবার বাঁশি বাজিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। অনেকের চোখে জল। এই অপেক্ষা ছিল দীর্ঘ, এই স্বপ্ন ছিল যুগ যুগ ধরে। আজ তা বাস্তবতায় রূপ নিল।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আবেগাপ্লুত সন্দ্বীপবাসী। দ্বীপের প্রবীণ বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বললেন, আজকের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটি আমাদের জন্য আশীর্বাদের মতো। এতদিন আমরা যেভাবে কষ্ট করে ট্রলার, স্পিডবোট বা জেটি নৌকার ওপর নির্ভর করতাম, সেই কষ্ট এবার লাঘব হবে।

দ্বীপের আরেকজন বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বললেন, আমরা বড় ধরনের ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেলাম। এখন ফেরিতে নিরাপদে যাতায়াত করতে পারব। তবে আমাদের চাওয়া, বর্ষার সময় যেন কোস্টাল ফেরি যুক্ত করা হয়, যাতে দুর্যোগকালেও চলাচল চালু থাকে।
শুধু প্রবীণরা নন, শিশুরাও এই পরিবর্তনের আনন্দে উদ্বেলিত। ১৩ বছরের কিশোর রায়হান বলল, আগে দাদুর বাড়ি যেতে হলে আমাদের কাদা-পানি পার হয়ে যেতে হতো। এবার আর সেই কষ্ট করতে হবে না।
চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে আসা এক যাত্রী বললেন, আমাদের স্বপ্ন ছিল নৌপথে নিরাপদ ও স্বল্প খরচে যাত্রা করার। আজ সেই স্বপ্ন সত্যি হলো।

সন্দ্বীপের সন্তার জেল বিএনপি নেতা বেলায়েত হোসেন বলেন, এই ফেরি সার্ভিস সন্দ্বীপবাসীর জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দ্বীপের বাসিন্দাদের নৌপথের নিরাপত্তা ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছিলাম। আজ সেটি বাস্তবায়ন হওয়ায় সন্দ্বীপবাসী উপকৃত হবে। তবে এটি টেকসই করতে নিয়মিত মনিটরিং ও সার্ভিসের মান উন্নয়নে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
ফেরি ঘাটে উপস্থিত হাজারো মানুষের কণ্ঠে তখন একটাই শব্দ “স্বাগতম!” কেউ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউ ফেরির ডেকে উঠে যাত্রীদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ফেরির ক্যাপ্টেন ও কর্মীদেরও অভিনন্দন জানানো হয়।
সন্দ্বীপের সন্তান চট্টগ্রাম উত্তর জেলা জামায়াতের আমীর আলাউদ্দিন সিকদার বলেন, আজ সন্দ্বীপের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। এই ফেরি শুধু যাতায়াত সহজ করবে না, দ্বীপের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং জীবনমানেও বড় পরিবর্তন আনবে।
সন্দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সরাসরি সংযোগ ছিল দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। এটি বাস্তবে রূপ নিতে নানা চ্যালেঞ্জ পেরোতে হয়েছে। অবশেষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চট্টগ্রামের বাঁশবাড়িয়া থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া পর্যন্ত ফেরি চলাচল শুরু হলো।
ফেরি পৌঁছানোর পর আবেগাপ্লুত হয়ে অনেকে বলেন, আজকের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এটি আমাদের জন্য আশীর্বাদের মতো। আমরা বড় ধরনের কষ্ট থেকে মুক্তি পাচ্ছি। আগে আমাদের নৌকা ও স্পিডবোটে ঝুঁকি নিয়ে চলতে হতো। সেই কষ্ট কমবে।” স্থানীয় কিশোররা জানায়, “আগে দাদুর বাড়ি যেতে কাদা-পানির মধ্যে নামতে হতো, এবার আর সে কষ্ট থাকবে না।
সন্দ্বীপের সন্তান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে সকলে ধন্যবাদ জানান। তারা বলেন, এই উদ্যোগ সন্দ্বীপের মানুষের জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল।
এতদিন সন্দ্বীপের মানুষকে স্পিডবোট ও ট্রলারে ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে হতো। বৈরী আবহাওয়া বা দুর্যোগপূর্ণ সময়ে দ্বীপটি কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য মূল ভূখণ্ডে আনা কঠিন হয়ে পড়ত। এখন ফেরির মাধ্যমে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে যাতায়াত সম্ভব হবে।
একজন বাসযাত্রী বলেন, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমাদের স্বপ্ন ছিল নৌপথে নিরাপদ ও স্বল্প খরচের যাত্রার, সেটি পূরণ হলো।
সন্দ্বীপের সন্তান ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান বলেন, এই ফেরি সার্ভিসের মাধ্যমে সন্দ্বীপ এখন জাতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হলো, যা দ্বীপের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ফেরিতে চলাচলের জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে- সাধারণ যাত্রী ১০০ টাকা, মোটরসাইকেল ২০০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৫০০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৯০০টাকা, বাস ৩ হাজার ৩০০ টাকা, ট্রাক ৩ হাজার ৩৫০টাকা এবং ১০ চাকার গাড়ি ৭ হাজার ১০০ টাকা ।
ফেরি কপোতাক্ষ’র মাস্টার সামশুল আলম বলেন, ফেরিতে ৬০০ জন মানুষ উঠতে পারবে। চলাচলের জন্য সাধারণ যাত্রী ১০০ টাকা, মোটরসাইকেল ২০০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৫০০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৯০০টাকা, বাস ৩ হাজার ৩০০ টাকা, ট্রাক ৩ হাজার ৩৫০টাকা এবং ১০ চাকার গাড়িন জন্য ৭ হাজার ১০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
সকালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিসের উদ্বোধন করা হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন এ সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। পরে ৯টায় ফেরিটি বাঁশবাড়িয়া থেকে সন্দ্বীপের পথে ছেড়ে যায়।
এ উপলক্ষে সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে এক সমাবেশ চলছে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি ভাষণ দেবেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। এই ফেরি শুধু একটুকরো লোহা আর ইঞ্জিনের সংযোগ নয়, এটি একটি স্বপ্ন, একটি সম্ভাবনা, একটি নতুন ভোর।